‘৯ মিনিটে পদ্মা পাড়ি’ প্রলোভনে যাত্রীরা
যাত্রীদের টানতে স্পিডবোটের হর্স পাওয়ার বাড়িয়ে ২৫ মিনিটেের নৌপথ মাত্র ৮ থেকে ৯ মিনিটে পাড়ি দেওয়া হচ্ছে। অনেক সময় জরুরি প্রয়োজনে যাত্রীরাই অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে দ্রুতগতির স্পিডবোটে নৌপথ পাড়ি দিচ্ছেন। আর এই সুযোগে মালিকরা স্পিডবোটের ইঞ্জিনের হর্স পাওয়ার বাড়িয়ে দিয়েছেন। এতেই ঘটছে দুর্ঘটনা। গত সোমবার (৩ মে) দুর্ঘটনার কবলে পড়া স্পিডবোটটি ছিল ২০০ হর্স পাওয়ার গতি সম্পন্ন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্পিডবোট চলাচল অবৈধ হলেও কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির কারণে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) প্রতি বছর স্পিডবোট ঘাট ইজারা দিয়ে থাকে। সেই সুযোগে মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ও মাদারীপুরের বাংলাবাজার ঘাটে স্পিডবোটের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ১৫-২০ বছর আগে যখন প্রথম নৌপথে স্পিডবোট চালু হয় তখন এর ইঞ্জিনের হর্স পাওয়ার ছিল মাত্র ৪০। এরপর এলো ৭৫ হর্স পাওয়ার। বর্তমানে যে সব স্পিডবোট চলছে তার বেশির ভাগ ১১৫ হর্স পাওয়ারের। আর কিছু সংখ্যক স্পিডবোট রয়েছে ২০০ হর্স পাওয়ারের। যার গতি প্রতি মিনিটে এক কিলোমিটারের চেয়েও বেশি।
বিজ্ঞাপন
যেহেতু পদ্মা নদী মাত্র ৬.১৫ কিলোমিটার তাই খুব সহজে ২০০ হর্স পাওয়ারের স্পিডবোট ৮ থেকে ৯ মিনিটে নৌপথ পাড়ি দিতে পারে। তাছাড়া এই ২০০ হর্স পাওয়ার ইঞ্জিন যে স্পিডবোট ব্যবহার করে তা অন্য স্পিডবোট থেকে অনেক বড় এবং যাত্রীও তুলতে পারে দ্বিগুণ।
মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া, মাদারীপুরের বাংলাবাজার ও মাঝিকান্দি নৌরুটে পদ্মা নদীতে যাত্রী পারাপারে চলে প্রায় চার শতাধিক স্পিডবোট। এসব স্পিডবোটের কোনো নিবন্ধন নেই। চালকের নেই কোনো লাইসেন্স। বিআইডব্লিটিএ স্পিডবোট ঘাটের ইজারা দিলেও এসব স্পিডবোট নিবন্ধিত নয়। নিবন্ধিত না হয়েও বছরের পর বছর ধরে পদ্মার বুকে চলছে স্পিডবোট।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন স্পিডবোট চালক বলেন, আমি ২০১২ সাল থেকে স্পিডবোট চালাই। আমি প্রথম যখন স্পিডবোট চালাই তখন স্পিডবোটের হর্স পাওয়ার ছিল ৪০। তারপর এলো ৭৫ হর্স পাওয়ার। বর্তমানে যে সব স্পিডবোট চলছে তার বেশিরভাগ ১১৫ হর্স পাওয়ারের। খুব কম সংখ্যক স্পিডবোটে রয়েছে ২০০ হর্স পাওয়ার। এ ধরনের স্পিডবোট চালানোর জন্য খুব দক্ষ চালক প্রয়োজন।
আরেক স্পিডবোট চালক জানান, একটি ২০০ হর্স পাওয়ার গতি সম্পন্ন ইঞ্জিনচালিত স্পিডবোট প্রতি এক মিনিটে এক কিলোমিটার এর চেয়েও বেশি পথ অতিক্রম করতে পারে। ৮ থেকে ৯ মিনিটে ১৩ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে পারে। এ ধরনের দ্রুতগতি সম্পন্ন স্পিডবোট চালাতে যথেষ্ট প্রশিক্ষণ এবং চালককে শারীরিক ও মানসিকভাবে ফিট থাকতে হয়। তাই মালিকপক্ষের উচিত দক্ষ চালক বাছাই করে তাদের দিয়ে এসব স্পিডবোট চালানো। তা না হলে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আর এ রকম ঘটছেও।
শিবচর উপজেলার নিয়ামতকান্দী গ্রামের বাসিন্দা শহিদুল মোল্লা বলেন, আমার ছোট ভাই শাহাদাত মোল্লা গত সোমবারের স্পিডবোট দুর্ঘটনায় মারা গেছে। সে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরছিল। আমি মনে করি স্পিডবোট চালক অদক্ষ ও নেশাগ্রস্ত ছিল। তাই দুর্ঘটনা ঘটেছে।
মাদারীপুর নৌ-পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রাজ্জাক জানান, স্পিডবোট চালকরা যাত্রীদের টানতে বলেন ৮ মিনিটে পদ্মা পাড় করে দেবেন। কিন্তু আসলে সেটা না। পদ্মা পাড় হতে এখনো আগের মত সময় লাগে। তবে আমার জানা মতে বেশ কিছু স্পিডবোট এখন ২০০ হর্স পাওয়ারের ইঞ্জিন ব্যবহার করে।
তিনি বলেন, স্পিডবোট কোনোটাই বৈধ না। কীভাবে বিআইডব্লিউটিএ তাদের ইজারা দেয় সেটা আমার বোধগম্য না।
বিআইডব্লিউটিএর শিমুলিয়া ঘাটের নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী পরিচালক শাহাদাত হোসেন জানান, কয়েক বছর আগে প্রায় ২৫ ভাগ স্পিডবোটের নিবন্ধন করা হয়েছিল। তবে আমাদের কাছে সেসবের কোনো নথি বা তথ্য নেই।
মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন জানান, প্রতিটি ঘাট ইজারা দিয়ে থাকে বিআইডব্লিউটিএ। তবে আমরা চাচ্ছি আগামীতে ঘাটসহ স্পিডবোট নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে। আমার জানা মতে কোনো স্পিডবোটের অনুমোদন নেই। তাছাড়া সেদিনের দুর্ঘটনায় আমাদের একটি তদন্ত কমিটি হয়েছে। সেই প্রতিবেদন হাতে পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
উল্লেখ্য, মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া থেকে সোমবার সকাল পৌনে ৭টায় ৩২ জন যাত্রী নিয়ে স্পিডবোটটি ছেড়ে আসে। এ সময় মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ী বাংলাবাজার পুরোনো ঘাটে থেমে থাকা বালুবোঝাই একটি বাল্কহেডে ধাক্কা দিয়ে ডুবে যায় স্পিডবোটটি। এ সময় সব যাত্রী পানিতে পড়ে যায়। পরে নদী থেকে একে একে ২৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ছয়জনকে জীবিত উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে আরও দুইজনের মৃত্যু হয়।
এ ঘটনায় মাদারীপুর জেলা প্রশাসন স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মো. আজাহারুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে ৬ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী তিনদিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
নাজমুল মোড়ল/আরএআর