ছোট ভাই শুয়ে আছে মায়ের কোলে। আর মাকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে পেছন থেকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে শিশু আবদুর রহমান। ওদিকে ঘরে রেখে এসেছে বাবাকে। কারণ, তিনিও পঙ্গু। চার সদস্যের সংসারে বলতে গেলে উপার্জনক্ষম এখন সে-ই। কিন্তু বয়সটা তো তার আয়রোজগার করার নয়। তাই পেটের দায়ে পঙ্গুত্ববরণ করা মাকে নিয়ে প্রতিদিনই ভিক্ষা করতে বের হয় আবদুর রহমান।

চুয়াডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন-সংলগ্ন রেল বস্তির বাসিন্দা আবদুর রহমানের মা প্রতিবন্ধী আম্বিয়া খাতুন। তার স্বামী আক্তার বিশ্বাস গ্রামগঞ্জে ফেরি করে বাদাম বিক্রি করতেন। কিন্তু নিয়তির কারণে তিনি এখন ঘরবন্দী। দুই ছেলে আবদুর রহমান (১২) ও আবদুল্লাহকে (৭ মাস) নিয়ে পঙ্গু দম্পতির দুঃখের সংসার।

জানা যায়, সাতক্ষীরা জেলার ঝাউডাঙ্গা ইউনিয়নের বলাডাঙ্গা গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে আম্বিয়া খাতুনের ১৩ বছর আগে বিয়ে হয় যশোর মণিরামপুরের বাদাম বিক্রেতা আক্তার বিশ্বাসের সঙ্গে। কিন্তু এখানে এসেও পিছু ছাড়েনি ভয়াবহ দরিদ্রতা। আম্বিয়ার স্বপ্ন ছিল স্বামীকে নিয়ে ছোট্ট একটি সংসার করবেন। স্বামী-সন্তানদের নিয়ে গড়ে তুলবেন সুখের সংসার।

পরে কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ করতে সাতক্ষীরা থেকে আম্বিয়া খাতুন স্বামী আক্তার বিশ্বাসের হাত ধরে চলে আসেন যশোর শহরে। থাকতেন একটি জীর্ণ বস্তিতে। স্বামীর বাদাম বিক্রির টাকা দিয়ে কোনোমতে চলত তাদের সংসার। বছর ঘুরতে না ঘুরতে আম্বিয়ার কোলজুড়ে আসে আবদুর রহমান। স্বামীর স্বল্প আয় থেকে কিছু টাকা জমাতে থাকেন আম্বিয়া খাতুন।

চুয়াডাঙ্গা শহরে মাকে নিয়ে নিয়মিত ভিক্ষা করে রহমান

২০১৮ সালে খুলনার শিরোমণির গিলাতলা মোহাম্মদীয়া হাফেজিয়া মাদরাসায় ভর্তি করান ছেলে আবদুর রহমানকে। ২০১৯ সালের মার্চে সারা দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়লে আবদুর রহমানকে মাদরাসা থেকে বাড়ি চলে আসতে বলে কর্তৃপক্ষ। আবদুর রহমান হাফেজিয়া পড়ার পাশাপাশি ওই মাদরাসায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ালেখা করত।

এদিকে অভাব যেখানে নিত্যসঙ্গী, তখনই আম্বিয়ার গর্ভে আসে নতুন সন্তান। এমনিতেই করোনার ভয়াবহতার মধ্যে সংসার চলে না, তার ওপর আরেক অতিথি। ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে প্রসববেদনা উঠলে স্ত্রীর মরণাপন্ন অবস্থা দেখা দেয়। পরে যে সম্বল ছিল, তা নিয়ে স্বামী আক্তার বিশ্বাস আম্বিয়া খাতুনকে ভর্তি করান হাসপাতালে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

চিকিৎসরা জানান, একলেমশিয়া হয়ে আম্বিয়ার শরীরের কোমর থেকে নিচের অংশ অসাড় হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে একটি চোখ। অনেক কষ্ট করে আবদুল্লাহ পৃথিবীর আলোর মুখ দেখলেও আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যান আম্বিয়া খাতুন। এ যেন সন্তান প্রসবের বেদনা কমতে না কমতে আরেকটি দুঃসংবাদ যেন আম্বিয়ার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।

আম্বিয়ার দুঃখের এখানেই শেষ নয়। যার কাঁধে ভর করে সব দুঃখ নিয়ে জীবন পাড়ি দেবেন, গত ১৫ ফেব্রুয়ারিতে সেই স্বামী আক্তার বিশ্বাসকে আলমডাঙ্গা উপজেলার মুন্সিগঞ্জ জেহালা এলাকায় একটি ট্রাক পেছন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। পরে পথচারীরা উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করালেও টাকার অভাবে ভালো চিকিৎসা না হওয়ায় সেও পঙ্গুত্ববরণ করে এখন বিছানায়।

তাই বাধ্য হয়ে সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে আম্বিয়া খাতুন অন্যের দেওয়া হুইলচেয়ার নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। ছেলে আবদুর রহমান ও আবদুল্লাহকে নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ান।

আম্বিয়া খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার সৎভাইদের অত্যাচারে বাড়ি ছেড়েছি। স্বামীকে নিয়ে ১০ মাস আগে চুয়াডাঙ্গায় আসি। রেল বস্তিতে ১২০০ টাকা ভাড়ায় একটি ঘরে থাকি। স্বামী শহরের বিভিন্ন স্থানে ফেরি করে বাদাম বিক্রি করতেন। কিন্তু চার মাস আগে সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ববরণ করেন তিনিও। তাই বাধ্য হয়ে আমি আমার দুই সন্তানকে নিয়ে রোজগারের আশায় বেরিয়ে পড়ি।

দিনে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পায়

প্রতিদিন কত টাকা আয় হয়, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ২০০ থেকে ৩০০ টাকা হয়। আবার কোনো দিন ১০০ টাকাও হয়। এটা দিয়েই সাধ্যমতো স্বামীকে চিকিৎসা করছি ও সংসার চালাচ্ছি। ডাক্তার বলছে, আরও উন্নত চিকিৎসা করা হবে। অনেক টাকা লাগবে। এখনই ওষুধ কিনতে টাকা নাই কাছে। ১০ থেকে ১২ দিন টাকার অভাবে ওষুধ কিনতে পারিনি। সরকারের কাছে স্থায়ীভাবে একটা ঘর চাই।

তিনি বলেন, আমার বড় ছেলে আমার কাজে সব সময় সাহায্য করে। রান্নাবান্নার কাজ থেকে শুরু করে ঘরে কাজ পর্যন্ত। এ ছাড়া জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে কিছুটা সাহায্য পেয়েছি। তা দিয়ে কয়েক দিন চলে। সামনে ঈদ। বড় ছেলে বায়না ধরেছে নতুন জামাকাপড়ের জন্য। জনপ্রতিনিধি বা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা যদি একটু এগিয়ে আসেন, তাহলে হয়তো পবিত্র রমজান মাসে সন্তানদের মুখে একটু হাসি ফোটাতে পারব।

স্বামী আক্তার বিশ্বাস বলেন, শহরে বাদাম বিক্রি করতাম। এক সড়ক দুর্ঘটনার পর থেকে দীর্ঘ চার মাস আমি বিছানায়। তাই আমার প্রতিবন্ধী স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে মানুষের কাছে ভিক্ষা করে যা পাই, তা দিয়েই টেনেটুনে সংসার চলছে। আমার চিকিৎসা খরচ, দুই সন্তানের ভরণপোষণ, বাড়ি ভাড়া দিতে গিয়ে হাত পাতা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

তিনি বলেন, কোনো দিন না খেয়েও থাকি। এ ছাড়া জেলা প্রশাসক আমার চিকিৎসার জন্য পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছেন। আমি চাই সরকারের কাছে আমাদের কোনো ব্যবস্থা করে দেওয়ার আবেদন জানাই।

চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ওই নারী ও তার স্বামীর বিষয়ে শুনেছি। সরকারিভাবে কিছু আর্থিক ও ত্রাণের সহযোগিতা করা হয়েছে। যেহেতু তারা চুয়াডাঙ্গার নাগরিক নন, তাই তাদের বলা হয়েছে, জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করে আনলেই সরকারের পক্ষ থেকে স্থায়ীভাবে ঘর করে দেওয়া হবে।

এনএ