মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত সৃষ্টির সেরা জীব বলে আখ্যায়িত। মানুষ সেরা জীব বলেই অন্য প্রাণের প্রতি তার অনুভূতি কাজ করে। গড়ে ওঠে সম্পর্ক! যার গভীরে কাজ করে অদৃশ্য এক শক্তি। যে শক্তি মানুষের চেতনাকে জাগ্রত করার মাধ্যমে মানুষকে গড়ে তোলে মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধসম্পন্ন। আর সম্পর্কের এ বন্ধন হতে পারে দেশের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে, হতে পারে পশু-পাখির সঙ্গেও।

এমনই এক অদৃশ্য ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ময়মনসিংহ নগরীর হামিদ উদ্দিন রোডের বাসিন্দা মৌসুমী আক্তারের সঙ্গে। তিনি হয়ে উঠেছেন মা! না, তিনি কোনো মানবশিশুর মা নন। পশুর প্রতি প্রেম-মমতায় হয়ে উঠেছেন পথের কুকুর-বিড়ালের মা। মায়ের মতো যত্নে-আদরে তাদের ঠাঁই দিয়েছেন নিজের ঘরে।

ছোটবেলা থেকেই পোষা প্রাণীর সঙ্গে সখ্য মৌসুমীর। একসময় স্বামী-সংসার সব ছিল তার। ১৪ বছর আগে মারা যায় তার একমাত্র শিশুকন্যা। একদিন স্বামীও চলে যান তাকে ছেড়ে। এরপর থেকে বঙ্গ, কঙ্কা, পিউ, ললিদের নিয়েই নিজের ভুবন সাজিয়েছেন মৌসুমী।

ঢাকা পোস্টকে মৌসুমী বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই এসব প্রাণীকে পছন্দ করি। যখন নিঃসঙ্গ হয়ে যাই, তখন তাদের প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়ি। আর ময়মনসিংহে বিড়াল-কুকুর লালন-পালনের সংস্কৃতিটা খুব কম। এ সময় চিন্তা করেই তখন আমিই তাদের নিয়ে একসঙ্গে থাকা শুরু করলাম। আশপাশে কোনো বিড়াল-কুকুর বাচ্চা দেওয়ার খবর পেলেই তাদের নিয়ে আসি।

মৌসুমী এমন ‘মানবিক’ কাজ করলেও বাসাবাড়িতে এসব বেওয়ারিশ প্রাণী লালন-পালন মেনে নিতে পারে না পাড়া-প্রতিবেশীরা। প্রায়ই তাকে শুনতে হয় নানা কটু কথা। তবু সব বাধাকে ছাপিয়ে ছয় বছর ধরে তাদের নিয়েই এক ছাদের নিচে বাস করে যাচ্ছেন মৌসুমী।

তিনি বলেন, আমি আমার বড় ভাইয়ের বাসায় আশ্রিত হিসেবেই থাকি। ভাই বিদেশে থাকেন। তবে কুকুর-বিড়াল নিয়ে থাকায় পাড়ার লোকজন এটা পছন্দ করেন না। বাসা নোংরা হয়ে যায়, পরিবেশ দূষিত হয়ে যায়। দুর্গন্ধে নাকি ধারেকাছে কেউ আসতে পারে না। এসব তারা আমার ভাইয়ের কাছে বিচার দিয়েছে। আর এসব শুনে বড় ভাইও আমাকে বাসা ছেড়ে চলে যেতে বলেছেন। কিন্তু আমার তো কোনো যাওয়ার জায়গা নেই। কোথায় যাব?

এই পশুপ্রেমী জানান, বর্তমানে তার বাসায় বিড়াল রয়েছে ১৯টি আর কুকুর রয়েছে ২টি। সম্প্রতি এক ভাইরাস ফ্লোতে মারা গেছে ১১টি বিড়ালছানা। তিনি নিজের ও এসব প্রাণীর খাবারের খরচ জোগাতে চালান একটি মুদি দোকান। এ ছাড়া পরিচিত পশুপ্রেমীরাও মাঝেমধ্যে হাত বাড়িয়ে দেন সহযোগিতার।

নিঃসঙ্গ জীবনে মৌসুমী আক্তারের সঙ্গী এখন পথের এ বিড়াল-কুকুরাই। তাই তার জীবনের একমাত্র পরম লক্ষ্যই হচ্ছে বেওয়াারিশ এসব প্রাণীকে রাস্তা থেকে তুলে এনে মায়ের মমতায় বড় করা। তার আশা, সরকারিভাবে জায়গা পেলে তাদের জন্য গড়ে তুলবেন নিরাপদ আশ্রয়।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার বিষয়ে মৌসুমি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এদের নিয়েই থাকতে চাই। এদের সেবা করতে চাই। তার রাস্তার মালিকহীন বিড়াল-কুকুর যেগুলো আছে, তারা আহত বা অসুস্থ হয়ে অনেক জায়গায় পড়ে থাকে, তাদের জন্য একটি আশ্রয় কেন্দ্র দরকার। সরকার থেকে যদি কোনো জায়গা আমাদের জন্য দেয়, তাহলে সেখানে ঘর বানিয়ে তাদের আশ্রয় ও সেবা দিতে পারব। আমার পরিচিত ময়মনসিংহের আরও কিছু উদ্যমী তরুণ-তরুণী রয়েছেন, তারাও পশুপ্রেমী। তারাও এদের জন্য কাজ করতে চান।

যে মমতা তারা পায় না, কেউ যাদের চায় না, সেই বোবা প্রাণীদের পরম যত্ন আর মায়ের মমতায় বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দিয়ে তৃপ্ত হন মৌসুমী। আর তাই তো এই অবুঝ প্রাণীদের সঙ্গে একই সূত্রে গেঁথেছেন তার জীবন।

এনএ