আনোয়ারা রাজ্জাক আনু চৌধুরী

৪৬ বছর ধরে ধাত্রী মাতার কাজ করে আসছেন তিনি। বিনিময়ে কারও কাছ থেকে নেননি টাকাপয়সা। এখনো করেন বিনামূল্যে। কোথাও কোনো মায়ের অসুস্থতার খবর পাওয়ামাত্রই ছুটে চলে যান তার কাছে। আবার দূরদূরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসেন তাকে নিতে। দীর্ঘ এ সময়ে তিনি ৩ হাজার সন্তানের ধাত্রীসেবা দিয়ে গর্ভবতী নারীদের কাছে এখন আস্থার প্রতীক হিসেবে পরিণত আনোয়ারা রাজ্জাক আনু চৌধুরী।

১৯৫৪ সালের ৩ জুন মাদারীপুর শহরের ৪ নম্বর শকুনি সৈদারবালী এলাকায় জন্ম আনোয়ারা রাজ্জাক আনু চৌধুরীর (৭০)। বাবা মরহুম চৌধুরী আতাহার উদ্দীন, মা সেতারা বেগম। পরিবারে তার চার সন্তান রয়েছেন।

জানা যায়, অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় মাদারীপুর সদর উপজেলা ঝাউদি ইউনিয়নের হোগলপাতিয়া গ্রামের মো. আব্দুর রাজ্জাক মিয়ার সঙ্গে বিয়ে হয় তার। বিয়ের পর স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায় উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। তার চার ছেলেকেও করেছেন সুশিক্ষায় শিক্ষিত। বড় ছেলে আবু ওবায়দুল হক রুবেল বেসরকারি চাকরিজীবী। মেজও ছেলে আবু রেজাউল হক রিপন করেন ঠিকাদারি ব্যবসা। সেজও ছেলে শফিকুল হক ইদুল ব্যবসা করেন এবং ছোট ছেলে আবু রফিকুল হক শিমুল একজন কেমিস্ট।

ফ্যামিল উইম্যান্স ভিজিটর (এফডব্লিউভি) বরিশাল থেকে ১৯৭৫ সালে ২ মাস প্রশিক্ষণ নেন আনোয়ারা রাজ্জাক। ১৯৭৬ সাল থেকে ধাত্রীসেবার কাজ করে যাচ্ছেন আনোয়ারা রাজ্জাক আনু চৌধুরী। ইতোমধ্যে প্রায় তিন হাজার মাকে ধাত্রী সেবা দিয়েছেন। এসব সেবা তিনি বেশির ভাগই দিয়ে থাকেন বিনামূল্যে। তার হাতে আজ পর্যন্ত কোনো শিশু মারা যায়নি।

ধাত্রীসেবার কাজটি তার কাছে আনন্দ, ভালোবাসা ও মনের খোরাকে পরিণত হয়েছে। তিনি মনের স্বাদ মেটাতে আজ পর্যন্ত এ কাজ করে চলেছেন।

১৯৭৬ সাল থেকে ধাত্রীসেবার কাজ করে যাচ্ছেন আনোয়ারা রাজ্জাক

১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন আনোয়ারা রাজ্জাক। নিজের ঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সংরক্ষণ করে রাখতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতেন বিভিন্ন সংবাদ। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এখনো পাননি কোনো স্বীকৃতি এই সংগ্রামী নারী ও তার স্বামী।

সংসার, ধাত্রীসেবার ও চার সন্তান মানুষ করাসহ সামাজিক কাজের পাশাপাশি সাহিত্যচর্চাও করে যাচ্ছেন আনোয়ারা। ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তার ‘অনেক সাধনার পর’, ‘পদ্মার ঢেউ’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ও ‘অবশেষে’ নামের চারটি কাব্যগ্রন্থ।

সাহিত্য ও ধাত্রীসেবার জন্য পেয়েছেন অনেক সম্মাননা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত গাঙচিল সাহিত্য সম্মাননা, কবি মো. আশরাফ আলী সাহিত্য সম্মাননা, কীর্তনখোলা গাঙচিল সাহিত্য সম্মাননা, জাতীয় কবি কাজী নজরুলের ১১৬তম জন্মবার্ষিকী উৎসব ২০১৫ সালে কবিতা ও চিকিৎসায় বিশেষ অবদানের জন্য বিশ্ব কবিতা কংগ্রেস মহাসম্মেলনে নজরুল সাহিত্য সম্মাননা, বাংলাদেশ সাহিত্য সংস্কৃতি সংস্থা থেকে চিকিৎসা ও কবিতায় অবদানের জন্য সম্মাননা, এশিয়ান জার্নালিস্ট হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড কালচারাল ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে কবিতায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৪ সালে সম্মাননা পেয়েছেন।

৪ নম্বর শকুনি এলাকার বাসিন্দা আরজু বেগম বলেন, আমার প্রথম যখন বাচ্চা হয়েছে, তখন আমি তার কাছে গিয়েছি। সফলভাবে তিনি আমার বাচ্চা প্রসব করিয়েছেন। এর কয়েক বছর পর আমার ছেলে হয়েছে। তখনো তিনি সেবা দিয়েছেন আমাকে। এরপর যখন আমার তৃতীয় বাচ্চা হয়, তখন তিনি আমাকে পরামর্শ দেন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তিনি এ পর্যন্ত অনেক মানুষের উপকার করেছেন। এ জন্য সবাই তার কাছে যায়।

সামাজিক কাজের পাশাপাশি সাহিত্যচর্চাও করে যাচ্ছেন আনোয়ারা

ফরিদ উদ্দিন মুফতি বলেন, আনু চৌধুরী আমাদের মাদারীপুরের জন্য গর্ব। তিনি ধাত্রী হিসেবে এলাকায় খুব পরিচিত। পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড করে থাকেন। কিছুদিন আগে আমার স্ত্রী যখন অসুস্থ হয়, তখন তিনি আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন।

আনোয়ারা রাজ্জাক আনু চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিনা টাকায় চিকিৎসাসেবা পাওয়ায় লোকমুখে আমার নাম ছড়িয়ে পড়ে। দূরদূরান্ত থেকে মায়েরা তার খোঁজ করতে থাকেন। দিনে দিনে আমার সুনাম ও চাহিদা বেড়ে যায়। আমি শুনেছি, ১০০টি মায়ের বাচ্চা ধরলে আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করবেন। আমি তো তিন হাজারের বেশি এই সেবা দিয়ে আসছি। আমি সবার কাছে দোয়া চাই আমি যাতে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানুষের সেবা করে যেতে পারি।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, যুদ্ধচলাকালীন আমি মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক সহযোগিতা করেছি। আমাদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন মিটিং হতো। আমার স্বামী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। কিন্তু সরকার আমাদের কোনো স্বীকৃতি দেয়নি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে একটু স্বীকৃতি চাই আমরা। একটি শেষ ইচ্ছা দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে সামনে থেকে জড়িয়ে ধরতে। তিনিও একজন নারী, দেশের জন্য তার যে অবদান রয়েছে, তা অকল্পনীয়।

সাহিত্য ও ধাত্রীসেবার জন্য পেয়েছেন অনেক সম্মাননা

মাদারীপুর মহিলাবিষয়ক উপপরিচালক মাহমুদা আক্তার কনা বলেন, আমি ছোটবেলা থেকে আনোয়ারা আপাকে চিনি। নারী সমাজে তার অনেক অবদান রয়েছে। বিশেষ করে তিনি ধাত্রীবিদ্যায় পারদর্শী।

মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাইফুদ্দিন গিয়াস ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাদারীপুরের গর্ব আনোয়ারা রাজ্জাক আনু চৌধুরী। শুনেছি তিনি একজন সফল ধাত্রী। ইতিমধ্যে তিনি প্রায় তিন হাজারেরও বেশি নারীকে ধাত্রীসেবা দিয়ে মা হতে সাহায্য করেছেন। এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় তার অনেক অবদান ছিল। কিন্তু তিনি কোনো স্বীকৃতি পাননি। এ ব্যাপারে আমরা চিঠি চালাচালি করব।

তিনি বলেন, তার শেষ ইচ্ছা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার। আমি মাদারীপুর জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি পাঠাব; তিনি যাতে তার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে পারেন।

মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আনোয়ারা রাজ্জাক আনু চৌধুরী যে ইতিমধ্যে তিন হাজার নারাকে ধাত্রীসেবা দিয়েছেন, এটা যেনে আমি আনন্দিত। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তার জন্য শুভকামনা থাকবে। তার সব ভালো কাজে আমরা তার পাশে আছি। আমরা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে  আনোয়ারা রাজ্জাকের সঙ্গে কথা বলব।

এনএ