মাদকাসক্ত স্বামীর অত্যাচার-নির্যাতনে সুখ মেলেনি সংসারজীবনে। মাদক গ্রহণ করে বাড়ি ফিরে মারধর করে বের করে দিয়েছেন বাড়ি থেকে। স্বামী বাড়ি থেকে বের করে দিলেও অবধারিত জায়গা হওয়ার কথা ছিল জন্ম দিয়ে মানুষ করা পাঁচ ছেলে-মেয়ের কাছে। কিন্তু তা হয়নি। স্বামীর মতোই ছেলেমেয়েদের কাছেও মিলেছে অবহেলা, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা। কোনো কূলকিনারা না পেয়ে চার বছর আগে নতুন একটি ঠিকানা পেয়েছেন জহুরা বেগম।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার ঝিলিম ইউনিয়নের আতাহার-দক্ষিণ শহর এলাকায় গড়ে উঠেছে বৃদ্ধাশ্রম ‘মহানন্দা প্রবীণ নিবাস’। স্বামী, ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি, সংসার― সব থাকা সত্ত্বেও অবহেলা ও নির্যাতনে এই বৃদ্ধাশ্রমে জায়গা হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার কল্যাণপুর এলাকার ৭৫ বয়সী জহুরা বেগমের।

রক্তের সম্পর্কের এত আপনজন থাকতেও এই নির্জন বৃদ্ধাশ্রমে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন জহুরা। কখনোই সুখ যেন তার পক্ষে ছিল না, এমনটাই মনে করেন তিনি। স্বামীর সংসারে প্রতিদিনের মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে করতে কেটেছে প্রায় পাঁচ দশক। মাদকাসক্ত স্বামীর অত্যাচারের পরও ছেলে-মেয়েদের ঠিকই নিরাপদে আদর-যত্নে মানুষ করেছেন তিনি। তবে বাস্তবে মানুষের মতো মানুষ করতে পেরেছেন কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে তার।

পাঁচ ছেলে-মেয়ে, বউ, জামাই, নাতি-নাতনিদের কারও সময় হয় না বৃদ্ধা জহুরার খোঁজ নেওয়ার। মহানন্দা প্রবীণ নিবাসের কয়েক শ মিটার দূরে কাজ করতে আসেন বড় ছেলে। তবু একবার দেখা করতে আসেন না। এরপরও ছেলে-মেয়েদের প্রতি বিন্দুমাত্র আক্ষেপ, ঘৃণা, ক্ষোভ কিছুই নেই জহুরা বেগমের। তার প্রত্যাশা, আরও ভালো থাকুক তার সন্তানরা। এটাই হয়তো মায়েদের চিরাচরিত চাওয়া ও দোয়া।

মহানন্দা প্রবীণ নিবাস

বৃদ্ধাশ্রমের মহিলা ওয়ার্ডের তার বেডরুমে বসেই কথা হয় জহুরা বেগমের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, অন্য আর পাঁচটা মায়ের মতোই ছেলে-মেয়েদের মানুষ করেছি। তারপরও আমাকে দেখে না। আল্লাহ কপালে যা লিখে রেখেছেন, তা-ই মেনে নিয়েছি। আল্লাহ তাদের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছেন। তারা আরও ভালো থাকুক, এটাই দোয়া করি সব সময়।

তিনি বলেন, এখানে (বৃদ্ধাশ্রমে) আসার আগে ছেলেদের বলেছিলাম। তারা বলেছিল, আমাদের কিছুই করার নেই। আসার সময় সবাইকে বললেও সবাই দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানায়। মাঝেমধ্যে বয়স্ক ভাতার টাকা তুলতে গিয়ে বাড়িতে গেলেও কেউ কথা বলে না।

এখানে আসার পর গত চার বছরে ৮টি ঈদ চলে গেছে। কিন্তু এই সময়ে কোনো ছেলে-মেয়ে খোঁজখবর নিতে আসেনি জানিয়ে জহুরা বেগম বলেন, নিজে কোনো কাপড় না কিনে ঈদের সময় এই ছেলে-মেয়েদের জন্য কত কষ্টে নতুন জামাকাপড়ের ব্যবস্থা করতাম। কিন্তু তারা এখন আমার খোঁজও নেয় না। এখন ছেলে-মেয়েরা বাসায় নিতে চাইলে যাবেন কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, না, যাব না। কারণ, ওখানে গেলে কে আমাকে দেখবে? আমি তো কোনো কাজ করতে পারব না। তাই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এখানেই থাকতে চাই।

বৃদ্ধাশ্রমের মহিলা নিবাসীদের দেখাশোনা করেন আয়েশা খাতুন। তিনি জানান, জহুরা বেগমের ছেলে-মেয়েরা কেউ দেখতে আসে না। তবে মাঝেমধ্যে তার এক নাতনি আসে। তাও আবার যখন তার বয়স্ক ভাতার টাকা পাওয়ার সময় হয়। কয়েক দিন আগে বয়স্ক ভাতার টাকা তুলতে গিয়ে বাসায় গেলে কেউ কথা বলেনি। অথচ প্রতিবার টাকা নিয়ে নেয় তারা। সেখান থেকে ফিরে এসে অনেক কান্নাকাটি করছিল। এ কারণে কয়েক দিন ধরে তার মন খুব খারাপ।

মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এখানেই থাকতে চাই

পাশের কয়েকটি গ্রাম দূরে বাড়ি দুই কলেজ ছাত্র তাসবিরুল আহমেদ শিমুল ও ইয়াসির আরাফাতের। মাঝেমধ্যেই দুই বন্ধু মিলে ঘুরতে আসে বৃদ্ধাশ্রমে। নিবাসীদের খোঁজখবর নিয়ে ও গল্প করে সময় কাটায় তারা। কথা হয় তাদের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে শিমুল বলেন, ছেলে-মেয়ে পরিবার থাকা সত্ত্বে অনেকেই বুকভরা দুঃখ-কষ্ট নিয়ে এখানে বসবাস করছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে আমার যেমন ভালো লাগে, তেমনি তাদের মনটাও হালকা হয়। তাদের জীবনের গল্পগুলো শুনলে কান্না চলে আসে।

ইয়াসির আরাফাত বলেন, বর্তমান সময়ে মাকে ভালোবাসা দিবসকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। এটি হওয়া উচিত নয়। প্রতিটি দিন আমাদের জন্য মা দিবস হওয়া উচিত। আর তা হলে এমন একটা নির্জন জায়গায় কেউ মাকে ফেলে ঘুমাতে পারবে না। আমরা চাই না সমাজে এমন নির্জন জায়গা গড়ে উঠুক। প্রতিদিনই মা দিবসের মতো করে থাকতে ও বৃদ্ধাশ্রমে ঘুরে আসতে সব ছেলে-মেয়েদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে সমাজসেবার অনুমোদন নিয়ে জেলার কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির উদ্যোগে জেলা শহরের গাবতলা মোড়ে গড়ে ওঠে মহানন্দা প্রবীণ নিবাস। পরে গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর গাবতলা থেকে আতাহার-দক্ষিণ শহর এলাকায় সাড়ে তিন বিঘা জমির ওপর নিজস্ব ভবনে বৃদ্ধাশ্রমটি স্থানান্তরিত হয়। বর্তমানে এখানে ১২ জন নারী, ৪ পুরুষ নিবাসী ও ৫ জন স্টাফ রয়েছেন।

এনএ