তবু ছেলের প্রতি কোনো ক্ষোভ নেই শেফালীর

‘দুই যুগ আগে স্বামীর ঘর ছেড়েছি। সন্তান তখন গর্ভে। স্বামী প্রতিদিন আমাকে মারত। ঘর ছাড়ার পর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি। কতজন কত প্রস্তাব দিয়েছে। বলেছে সন্তান ফেলে দিয়ে নতুন করে ঘর বাঁধতে। কিন্তু সন্তানের মায়া বড় মায়া। সন্তানের মায়ায় আর ঘর বাঁধতে ইচ্ছে করেনি।’

এভাবেই নিজের জীবনের গল্প বলছিলেন বাগেরহাট সদর উপজেলার বেমরতা ইউনিয়নের চিতলী-বৈটপুর গ্রামের বাসিন্দা শেফালী বেগম (৪০)।

তার বাবা নওয়াব আলী শেখ ও মা নুরজাহান বেগম মারা গেছেন অনেক আগেই। একমাত্র সন্তানকে পেটে নিয়ে ২৪ বছর আগে খুলনার পাইকগাছা থেকে স্বামী রহমত মোল্লার অত্যাচারে সংসার ছেড়ে চলে আসেন। দুমুঠো ভাতের জন্য কখনো মাটি কেটেছেন, কখনো ভ্যান চালিয়েছেন, ঠেলাগাড়ি ঠেলেছেন, কখনো বা করেছেন বাবুর্চির কাজ।

অথচ যে ছেলেকে বাঁচাতে ফের ঘর বাঁধেননি, বিসর্জন দিয়েছেন জীবনের সব স্বপ্ন। সেই ছেলেই আজ ভুলে গেছেন মাকে। তবু ছেলের প্রতি কোনো ক্ষোভ নেই শেফালীর। বলেন, ‘তার নিজেরই চলতে কষ্ট হয়, বউ-বাচ্চা আছে। আমারে কীভাবে দেখবে?’

শেফালী বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বিয়ে হয় ১৫ বছর বয়সে। ১৬ থেকে ১৭ বছর বয়সে স্বামীর নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে একমাত্র সন্তানকে পেটে নিয়ে সংসার ছেড়ে চলে আসি। বাগেরহাটে আসার পর পেটে সন্তান থাকায় তেমন কোনো কাজ করতে পারতাম না। ভিক্ষা করেই জীবন বাঁচিয়েছি। পরবর্তীতে সন্তান শাকিলের জন্মের বছর দুয়েক পরে ভিক্ষা বন্ধ করে বিভিন্ন ধরনের কাজ শুরু করি। মাটি কাটা, সড়ক সংস্কার, ভ্যান চালানো, ঠেলাগাড়ি ঠেলা, চাল ও কাঠের মিলে কাজসহ নানান কাজ করে ছেলেকে বড় করেছি।

মাটি কাটা, সড়ক সংস্কার, ভ্যান চালানো, ঠেলাগাড়ি ঠেলা, চাল ও কাঠের মিলে কাজসহ সব করেছি

তিনি বলেন, বছর পাঁচেক আগ থেকে ছেলে বিয়ে করে বউ নিয়ে আলাদা থাকে। আগে আমাকে একটু সাহায্য-সহযোগিতা করলেও করোনা শুরু হওয়ার পর আমার খোঁজ নিতে পারে না। কারণ ওর তো নিজের সংসারই চলে না। এখন মাঝেমধ্যে কাজে যাই, আর কাজ না থাকলে রাস্তার পাশে বিভিন্ন ডোবা থেকে শাক-পাতা তুলে বিক্রি করি। শাক বিক্রি করে যে আয় হয়, তাতে দুই বেলার খাবারও হয় না। খেয়ে না খেয়েই দিন যায়। কত জায়গা দরখাস্ত দিয়েছি, কতজনের কাছে গেছি। কিন্তু কিছুই পাইনি। এলাকার মানুষেরও খুব অভাব। কেউ যে একটু সাহায্য করবে, তেমন অবস্থা নেই।

শেফালী বলেন, বিয়ের আগে খুলনার এক বাড়িতে কাজের মেয়ে হিসেবে থাকতাম। তারাই বিয়ে দিয়েছিল। একমাত্র বোন পারভীন বেঁচে আছে। অনেক দিন দেখা হয় না। পারভীন অন্ধ। অন্যের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। ছেলে আলাদা থাকে। এই পৃথিবীতে আমার নিজের বলতে কেউ নেই। ছেলের দিকে তাকিয়ে এত বছর বেঁচেছি। ছেলে কাছে নেই তাই আর বাঁচার ইচ্ছেও নেই।

শেফালীর প্রতিবেশী আয়েশা আক্তার মরিয়ম ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রায় দুই যুগ আগে শেফালী এই এলাকায় আসেন। কতইবা বয়স তখন, ১৬ বা ১৭ বছর। ভ্যান চালিয়ে, ঠেলাগাড়ি ঠেলে, রাস্তার কাজসহ বিভিন্ন কাজ করে ছেলেকে বড় করেছেন তিনি। কী যে কষ্ট করেছে ও, তা না দেখলে বিশ্বাস হয় না। কিন্তু এখন শরীর নিয়ে আর পারে না। শাকসবজি বিক্রিই ওর একমাত্র ভরসা। শুনেছি ছেলেও মায়ের তেমন খোঁজখবর নেয় না। আমাদের কাছে মাঝেমধ্যে আসে। যখন যা পারি, তা দিয়ে সহযোগিতা করার চেষ্টা করি।

ভ্যান চালিয়ে, ঠেলাগাড়ি ঠেলে, রাস্তার কাজসহ বিভিন্ন কাজ করে ছেলেকে বড় করেছেন

শেফালীর বাড়ির মালিক তাসলিমা বেগম বলেন, পাঁচ বছর ধরে শেফালী আমাদের বাড়িতে ভাড়া থাকে। অন্য ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে ৬০০ টাকা নিলেও শেফালীর কাছ থেকে আমরা ৫০০ টাকা নিই। শুধু ভাতের জন্য দিন-রাত কষ্ট করে বেচারী। দীর্ঘদিন এই এলাকায় থাকলেও কেউ কোনো দিন ওর খোঁজখবর নেয়নি। ছেলে ছাড়া কোনো আত্মীয়স্বজন আছে কি না, তা-ও জানি না। শুনেছি ছেলের জন্যই শেফালী ওর জীবনের সব স্বাদ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছে। কিন্তু ছেলে বেশি খোঁজ নেয় না। ছেলের কথা বলে মাঝেমধ্যেই একা কান্নাকাটি করে। আমরা শুনি, সান্ত্বনা দিই। এ ছাড়া তো আমাদের আর কিছু করার নেই।

বেমরতা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. আকরামুজ্জামান রিক্ত ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০ বছরের বেশি সময় ধরে শেফালী দেখছি। অমানবিক পরিশ্রম করে। খুব কষ্ট করে খায়। একা থাকলেও স্বভাব-চরিত্র খুবই ভালো। ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে আগে একবার ভিজিএফ কার্ডের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। এ ছাড়া আমরা আমাদের সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টা করি তাকে সহযোগিতা করার।

বাগেরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ মুছাব্বেরুল ইসলাম বলেন, শেফালীর বিষয়টি আমি শুনেছি। শেফালীর নিজস্ব কোনো জায়গা-জমি নেই। তিনি ভাড়া বাড়িতে থাকেন। আমরা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে খাদ্যসহায়তা দেব। এ ছাড়া সরকারি যেকোনো একটি পুনর্বাসন কর্মসূচির আওতায় শেফালীকে সাহায্যের আশ্বাস দেন তিনি।

এনএ