ট্রলারযোগে পদ্মা পার হচ্ছেন মিলন খলিফা

করোনার সংক্রমণ রোধে সরকারঘোষিত লকডাউনে দূরপাল্লার বাস বন্ধ রাখলেও প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, পিকআপভ্যানে নাড়ির টানে শহর ছাড়ছে মানুষ। কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। শত দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে বাড়ি ফেরা মানুষের একজন ঝালকাঠি সদর উপজেলার মিলন খলিফা। সাভারের আশুলিয়া থেকে সাহরির পর রওনা দিয়ে ২১ ধাপে বাড়ি যেতে ১৫ ঘণ্টা লেগেছে তার। যাত্রাপথে পদ্মার চরে লুকিয়েছেন দুবার। শেষমেষ বাড়ি ফেরার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা জানালেন।

মিলন খলিফা বলেন, মঙ্গলবার (১১ মে) ভোর সোয়া ৪টায় আশুলিয়া থেকে অটোরিকশায় উঠি। গন্তব্য আব্দুল্লাহপুর। কিন্তু যেতে পারলাম না। ভাড়া ২৫ টাকা দিয়ে নেমে গেলাম। দ্বিতীয় ধাপে আরেক রিকশায় ২৫ টাকা দিয়ে আব্দুল্লাহপুর পৌঁছাই। ১৫ টাকার ভাড়ার স্থলে গেল ৫০।

তৃতীয় ধাপে আব্দুল্লাহপুর থেকে ৫০ টাকার ভাড়া ৮০ টাকা দিয়ে আজমেরী পরিবহনে সদরঘাটে এলাম। কিন্তু সদরঘাটে ঘরে ফেরা মানুষের ভিড়ে পা ফেলার জায়গা নেই। চতুর্থ ধাপে হেঁটে বাবুবাজার ব্রিজ পৌঁছলাম। বাবুবাজার থেকে মাওয়া ঘাট পর্যন্ত অটোরিকশা ভাড়া চায় ৫০০ টাকা। অথচ নিয়মিত ভাড়া ১০০ টাকা। বেশি ভাড়ার কারণ জানতে চাইলে চালক জানান রাস্তায় পুলিশ আছে। বিকল্প রাস্তায় যেতে হবে। আধা ঘণ্টার পথ যেতে দুই ঘণ্টা লাগবে।

মিলন খলিফা

দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে উপায় না পেয়ে পঞ্চম ধাপে কয়েকজন লোকের সঙ্গে ভ্যানে করে বাবুবাজার ব্রিজে আসি ১০ টাকা ভাড়ায়। ষষ্ঠ ধাপে সেখান থেকে আমি ও আরও দুজন অটোরিকশাযোগে কুচিয়ামারা ব্রিজ পর্যন্ত যাই। প্রত্যেককে ভাড়া দিতে হয় ৩০০ টাকা। এরপর পুুলিশ আটকে দেয়। সপ্তম ধাপে হেঁটে দুই কিলোমিটার পথ অতিক্রম করি। দেখলাম, আমার মতো অনেক নারী-পুরুষ; এমনকি শিশুরা হাঁটছে।

অষ্টম ধাপে অটোরিকশায় উঠি মাওয়া ঘাটে যাওয়ার জন্য। একেক জনের ভাড়া ২০০ টাকা। আমিসহ চারজন যাচ্ছিলাম। অবশেষে মাওয়া ঘাটে পৌঁছলাম। দেখলাম হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। ফেরি চলে না।

নবম ধাপে এক অটোরিকশাচালক বললেন পদ্মা পাড়ি দেওয়ার বিকল্প পথ হিসেবে ট্রলারঘাটে নিয়ে যেতে পারবেন। তাকে জনপ্রতি ৫০ টাকা দিতে হবে। আমরা চারজন তার অটোরিকশায় উঠলাম। কিন্তু চালক মাঝপথে আমাদের একটি বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সবাই ভয় পেলাম। বাড়িতে আনার কারণ জানতে চাইলে বললেন এখন ঘাটে পুলিশ আছে। আমাদের ঘরে বসতে বললেন। তবে কেউ রাজি হলেন না ভয়ে। বাড়ির আরেকজন বললেন আপনারা আমার সঙ্গে হেঁটে চলুন, ঘাটে নিয়ে যাব।

দুই কিলোমিটার হাঁটার পর একটি চরে পৌঁছলাম। চরে গিয়ে ৫ মিনিট দাঁড়ানোর পর ট্রলার এলো। মাছ ধরার ছোট ট্রলার। আমরা চারজন। ট্রলারচালক আরও তিনজন যাত্রী ঠিক করলেন।

পদ্মা পাড়ির অপেক্ষায় মিলন খলিফা

১১তম ধাপে যখন ট্রলারে উঠব তখন পুলিশ আসছিল। সবাই পালাল। ট্রলার নিয়ে নদীর মাঝে চলে গেলেন চালক। কিছুক্ষণ পর আরেক ট্রলার ডাক দিলেন।

১২তম ধাপে আমরা ১৩ জন ট্রলারে উঠলাম। নদীতে পুলিশের টহল চলছে। কিছুদূর না যেতেই দেখলাম নদীতে অন্য একটি ট্রলার থেকে যাত্রীদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। সবাই ভয় পেলাম। ট্রলার যখন মাঝ নদীতে ঠিক তখন পুলিশ আমাদের দেখেছে। ট্রলারের মাঝি দ্রুত সবাইকে নিকটবর্তী চরে নিয়ে গেলেন। দুর্গম চরে সবাই লুকিয়ে পড়লাম।

১৩তম ধাপ শুরুর আগে দেখে নিলাম পুলিশ চলে গেছে না কি আছে। যখন দেখলাম, পুলিশ নেই তখন নদী পার হওয়ার তৃতীয় প্রচেষ্টা শুরু হলো। অবশেষে দেড় ঘণ্টা ট্রলারে চড়ে নদী পার হলাম সবাই। মাঝিকে সবাই ৩০০ টাকা করে দিলাম। ট্রলার থেকে নেমে সবাই কাঁঠালবাড়ি ঘাটে যাওয়ার জন্য গাড়ি খুঁজছিলাম। মোটরসাইকেলে জনপ্রতি ৩০০ টাকা করে চাচ্ছিল।

১৪তম ধাপে অতিরিক্ত ভাড়া চাওয়ায় হাঁটা শুরু করলাম। তিন কিলোমিটার হাঁটলাম। পথে ভোলার তিনজনকে পেলাম। ১৫তম ধাপে জনপ্রতি ১৫০ টাকা করে ভাড়ায় অটোরিকশায় কাঁঠালবাড়ি ঘাটে আসলাম চারজন।

১৬তম ধাপে বরিশাল যাওয়ার জন্য মাইক্রোবাসে জনপ্রতি ১ হাজার টাকা ভাড়া চান চালক। মাহিন্দ্র গাড়িতে জনপ্রতি চাচ্ছিল ৫০০ টাকা। মাহিন্দ্রতে উঠলাম। গাদাগাদি করে যাত্রী নেওয়া হয়েছিল; হাত নাড়ানোর সুযোগ ছিল না। এভাবে ভুরঘাটা পর্যন্ত এলাম। পরে গাড়ি পরিবর্তন করে ১৭তম ধাপে টরকি পর্যন্ত এলাম। আবার গাড়ি পরিবর্তন করলাম।

পুলিশ দেখে পদ্মার দুর্গম চরে আশ্রয় নেন

১৮তম ধাপে বরিশাল নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালে এলাম। ১৯তম ধাপে অটোরিকশায় ১৫ টাকা ভাড়ায় বরিশাল রূপাতলী বাস টার্মিনালে এসে পৌঁছাই। বন্ধুকে ফোন দিলাম মোটরসাইকেল নিয়ে এগিয়ে আসতে। বন্ধু আমাকে কালিজিরা পর্যন্ত আসতে বলল। কালিজিরা ব্রিজের পর ঝালকাঠি জেলা শুরু। ২০তম ধাপে অটোরিকশায় ১৫ টাকা ভাড়ায় কালিজিরা আসলাম। এরপর বন্ধুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনটা ভরে গেল।  

মিলন বলেন, পরিবারের সঙ্গে ঈদ করার জন্য সবাই কত কষ্ট করে বাড়ি যাচ্ছে। রাস্তায় দেখেছি, কেউ কেউ বলছেন; আমার পকেটে সেমাই কেনার টাকাও নেই। তবু বাড়ি যাচ্ছি।

তিনি বলেন, হয় পুরো লকডাউন থাকবে, না হয় যাত্রীরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে কীভাবে বাড়ি যেতে পারবেন তার নির্দেশনা থাকবে। কিন্তু কিছুই করল না সরকার। মানুষের দুর্ভোগ দেখল না।

২১তম ধাপে বন্ধুর মোটরসাইকেলে ১৫ ঘণ্টায় ১৬৭০ টাকা খরচ করে ইফতারির আগে বাড়ি পৌঁছাই। রোজা রেখে হেঁটেছি ১০ কিলোমিটার। পরিবারের সদস্যদের দেখে পথের কষ্ট ভুলে গেলাম।

এএম