বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল তাদের মেধাবী ছেলে একদিন বড় ইঞ্জিনিয়ার হবে। সেই স্বপ্ন পূরণে ছেলে ঠিকই মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডিগ্রি নিয়ে শুরু করেছিলেন পেশাগত জীবন। কিন্তু পেশার চেয়ে নেশাটাই হয়ে উঠল সেই মেধাবী ছেলেটির প্রথম পছন্দ। 

তবে এ নেশা মাদকের নয়। নিপীড়িত আর খেটে খাওয়া মানুষের পাশে দাড়াঁনোর নেশা। কখনও উপার্জনের অর্ধেক টাকা কিংবা প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার ভয়কে জয় করে পারিবারিক সম্পদ নিয়েই রাত দিন ছুটে চলেছেন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দ্বারে। 

সময়ের বিবর্তনে সেই ইঞ্জিনিয়ার মাসুদুর রহমান নামের ছেলেটি এখন মাসুম চেয়ারম্যান। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হয়েছেন একাধিকবার। শুধুমাত্র মানুষের পাশে দাড়াঁনোর তার এই মজ্জ্বাগত স্বভাবের কারণে এলাকার মুরুব্বীরা নাম দিয়েছেন ‘মানুষ পাগল চেয়ারম্যান’।

তবে গত বছর থেকে চলতি বছরে করোনাকালে তিনি মানুষের পাশে দাড়াঁনোর ক্ষেত্রে সৃষ্টি করেছেন উদাহরণ। গত বছর প্রথম লকডাউন থেকেই নিজের ফেসবুক পেজে মোবাইল নম্বর দিয়ে ঘোষণা দিয়েছেন, দিন কিংবা রাত হোক, খাদ্য আর ওষুধের প্রয়োজন হলেই যেন তাকে ফোন দেয়া হয়। তার এ সহযোগিতা আর পাশে দাড়াঁনোর ক্ষেত্রে বাদ পড়েননি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাও। তাই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কাছেও শোনা যায় তার এ স্বভাবের সুনাম।

পিরোজপুরের ৯টি ওয়ার্ডে গ্রাম রয়েছে মোট ৩৮টি। বেশ কয়েকটি গ্রামে ঘুরে পাওয়া গেল এ মানুষ পাগল চেয়ারম্যানের নানা কাহিনী। ৭নং ওয়ার্ডের ভবনাথপুর গ্রামের নরসুন্দর শঙ্কর শীল। 

কথার ছলে স্থানীয় চেয়ারম্যানের কথা জানতে চাইলে তিনি বললেন, ভালা মানুষ। তারে খুঁজতাছেন? নম্বর আছে আমার কাছে, লাগলে নেন। পিরোজপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আতিক উল্লাহর সঙ্গে দেখা হলো। 

তিনি জানালেন, ও তো পাগল, মানুষের জন্য কিছু করতে পারলে সে খুব খুশি হয়। গত বছর পুরো ইউনিয়নের ৩৬ জন মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে খুঁজে তাদের বাড়িতে গেছে। আমার বাড়িতেও এসেছিল। বিশাল এক ডালা ভরে ফল আর খাদ্যসামগ্রী নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। নম্বর দিয়ে গেছে যাতে কোনো কিছু লাগলে ফোন দেই। 

ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের ভাটি বন্দর গ্রামে বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করেন। সেখানে গিয়ে মূল রহস্য জানতে চেয়ারম্যান মাসুম সম্পর্কে কিছু নেতিবাচক কথা বলার পরপরই মারমুখি আচরণ শুরু করছিলেন কেউ কেউ। অবস্থা বেগতিক দেখে সেখানকার একজন বললেন, মাসুম চেয়ারম্যানী কইরা টেকা চুরি করে না। করোনার সুম (সময়) পুরা ইউনিয়নের প্রায় ৩৫ হাজার ভোটারের কাগজ লইয়া তাগো খাওন দিছে। এইবারও দিতাছে। কেউ সামনে গিয়া যদি কইছে পাই নাই, তাইলে উল্টা সরম পাইয়া লগে লগে তারেও দেওনের ব্যবস্থা কইরা দেয়। এমন মাইনসেরে খারাপ কই কেমনে।
 
কথা হলো ওই এলাকার পত্রিকার হকার সোলায়মান মিয়ার সঙ্গে। তিনি বললেন, শুধু পিরোজপুর না, মাসুম চেয়ারম্যান পাশের ইউনিয়নেও দিয়েছেন। জামপুর, সনমান্দি, নোয়াগাঁও, শম্ভুপুরা, পৌরসভা ও মোগরাপাড়া ইউনিয়ন ছাড়াও তিনি হিজড়া ও বেদে সম্প্রদায়, ইমাম, মাদরাসা শিক্ষক, ভিক্ষুক ও পত্রিকার হকারদের মধ্যেও খাদ্য সহায়তা দিয়েছেন।

সম্প্রতি করোনার প্রাদুর্ভাবে টাকার অভাবে নবজাতককে বিক্রি করা ওই পরিবারের পাশেও দাঁড়িয়ে ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন ইঞ্জিনিয়ার মাসুম।

সবশেষে কথা হয় সেই মানুষ পাগল খ্যাত চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মাসুুদুর রহমান মাসুমের সঙ্গে। তিনি জানালেন, আমি যেমন একটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, তেমনি সোনারগাঁ উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক। তাই সহযোগিতার ক্ষেত্রে আমাকে নিরপেক্ষ থাকা উচিত বলেই প্রতিটি ওয়ার্ডের গ্রামে গ্রামে শিক্ষক, সাংবাদিক, দলীয় নেতাকর্মী ও ইউপি সদস্যদের সমন্বয়ে স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপ তৈরি করে অসহায় মানুষের খোঁজ খবর নিয়ে তাদের ঘরে খাবার পৌঁছে দিচ্ছি। 

তিনি বলেন, আমার এলাকায় দেশের বেশ কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপের কারখানা রয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের সরকিরি বরাদ্ধ ও ব্যক্তিগত অর্থায়নে বিশাল এ জনগোষ্ঠীকে সহযোগিতা করা প্রায় সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই আমি ওইসব শিল্প গ্রুপকে মানুষের দুর্দশার কথা বলি। আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। তারাও সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তবে শিল্প গ্রুপের যত সহযোগিতা সেগুলো স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমেই আমরা বিতরণ করি। 

মাসুম চেয়ারম্যান বলেন, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মতো আনন্দ পৃথিবীর আর কোনো কাজে নেই। 

এমএএস