অসহায় লাইলি বেগম

পবিত্র ঈদুল ফিতর আজ। একমাস সিয়াম সাধনার পর ঈদের আনন্দে মেতেছে মুসলিম সম্প্রদায়। শুধু মুসলিম সম্প্রদায় নয় দিনটিকে ঘিরে সকল ধর্মের মানুষদের সঙ্গে সম্প্রীতি বজায় রাখার সংস্কৃতি চালু আছে দেশে। ঈদের দিন যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী নতুন পোশাক পরেন, খাবারের আয়োজন করেন। কিন্তু অর্থ যাদের হাতের মুঠোয় ধরা দেয়নি সেই নিম্নবিত্ত ও শ্রমিক শ্রেণির মানুষের কেমন কাটছে ঈদ? বৃহস্পতিবার (১৩ মে) কয়েকজন নিম্নবিত্ত মানুষের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের। 

তেমনি একজন ব্যক্তি আনুমানিক ৫০ বছর বয়সী ইসমাইল হাওলাদার। তার বাড়ি বরিশাল নগরী থেকে কীর্তনখোলা বিচ্ছিন্ন সদর উপজেলার চরকাউয়া ইউনিয়নের চরকাউয়া গ্রামে। পেশায় তিনি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। নগরীর সিটি মার্কেটে শাক-সবজির ব্যবসা করেন। 

ইসমাইল হাওলাদার জানান, বছর পাঁচেক আগে তার স্ত্রী মারা গেছেন। চার সন্তানের মধ্যে তিন মেয়ে আর এক ছেলে। ছেলের বয়স ১২ বছর। শাক-সবজি বিক্রি করে দিনে যা আয় করেন তা দিয়ে অতিরিক্ত কিছু টাকা জমিয়ে ছেলের জন্য ঈদে কিছু দিতে পারেননি। এজন্য রাতে বাড়িতে ফিরবেন না।

তিনি বলেন, কোন মুখে ঘরে যামু? পকেটে টাকা নাই। মাইয়া কয়ডা হউর বাড়ি (শ্বশুরবাড়ি)। আইজ সন্ধ্যা পর্যন্ত দেখছি পাঁচশ-ছয়শ টাহা বেশি আয় করতে পারি কিনা; হ্যালে একটা জামা আর প্যান্ট কিন্না দিতাম। কিন্তু আয় হইছে সাড়ে তিনশ টাহা। আর আছে মূলধন দেড় হাজার টাহা। এই জন্য পোলারে কইছি বড় মাইয়ার বাড়ি চইল্যা যাইতে। হেই বাড়ি ভালোমন্দ যা পারে খাইবেআনে।

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইসমাইল বলেন, মুইও ছোটকালে ঈদ করতাম। আর বুজ হওনের পর শ্যাষ কবে ঈদ করছি মনে নাই। গত ২০-৩০ বচ্ছরেতো করিই নাই। আর এবার টাহার অভাবে বাড়ি যাই নাই, পোলারে থুইয়া পলান দিলাম। রাতে যাত্রী ছাউনিতে থেকে শুক্রবার (১৪ মে) দুপরের দিকে বাড়ি ফিরবেন বলে জানান তিনি।

ইসমাইল হাওলাদার

আরেক অসহায় লাইলি বেগম। বয়স ৪০-৪৫ হবে বলে তার ধারণা। কমপক্ষে ৩০ বছরই কাটিয়ে দিয়েছেন বরিশাল নদী বন্দর এলাকায়। নদী বন্দরের আশপাশে সস্তায় যে কয়টি খাবার হোটেল আছে তাতে কখনো বাসন-কোসন ধুয়ে দেন। আবার কখনো মানুষের কাছে হাত পাতেন। তার মূল বাড়ি খুলনার খালিসপুরে। মা-বাবা মারা যাওয়ার পরে বরিশালে এসেছেন ছিন্নমূল হয়ে। তারপর ঘর বেঁধেছিলেন ভোলার এক যুবকের সঙ্গে। সেই যুবক যখন আরেক বিয়ে করে চলে যান তখন থেকেই পন্টুনে থাকেন।

লাইলি বলেন, কাঁচা চুলে আমার পাক ধরছে এই লঞ্চঘাটে। মনে চায় নিজরে বাড়ি ফিরে যাই। কিন্তু কই যামু বাপ, আমারতো কোনো বাড়িঘর নাই। 

তিনি গুনে গুনে বলেন, জীবনে তিনবার ঈদ করছি, মনে আছে। তখন আব্বা বাইচা আছেন। আব্বা মারা যাওয়ার পর সব শ্যাষ। এখন আর ঈদ বইলা জীবনে কিছু নাই। সবই সমান।

বিমল চন্দ্র

বরিশাল সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের রসুলপুরের বাসিন্দা বিমল চন্দ্র জন্মগতভাবে পঙ্গু। ভারি কোনো কাজ করতে পারেন না। যতটুকু কাজ পারেন তা করেই টাকা আয়ের চেষ্টা করেন। কিন্তু করোনা আসায় সেই পথ বন্ধ হয়ে গেছে।

বিমল বলেন, আমি হিন্দু হইলেও আগে জামা-কাপড় টাকা পাইতাম। বড়লোক মানুষ এসে দিয়ে যেত। হাত খরচার টাকাও দিত। কিন্তু এখন কেউ আসে না আমাদের মত অসহায়দের সাহায্য করতে। 

তিনি বলেন, ধর্মেতো বলে নাই হিন্দুরা ঈদ করতে পারবে না। ছোটবেলা থেকেই ঈদের দিন ভালো কিছুর আয়োজন হত ঘরে। কিন্তু এখন আর হয় না। তার উপরে সংসার নেই। ফলে ঈদ আসলেও আনন্দ আসে না। 

এদিকে সন্ধ্যা থেকেই নদী বন্দর এলাকায় জটলা করে মেহেদি লাগানোর ধুম শুরু হয়। একে অপরের হাতে মেহেদি লাগিয়ে দেয়। মেয়ে আর ছেলের বিভেদ নেই। যে একটু ভালো পারে তার কাছে সবাই গিয়ে হাত পাতেন। পন্টুনের কুলি, ভবঘুরে, ভিক্ষুক, ছিনতাইকারী, ছিন্নমূল শিশু, ভ্রাম্যমাণ যৌনকর্মী সব আছে এখানে। ঈদ এসেছে তাই কোনো বাদবিচার না করেই মেহেদি উৎসব ছড়িয়ে পড়ে লঞ্চঘাটে।

নদী বন্দর এলাকায় জটলা করে মেহেদি লাগানোর ধুম পড়ে

শ্রমিক হাফিজ বলেন, রমজান মাসে পোর্টরোড, চকবাজার, মহসিন মার্কেট ও লঞ্চঘাট এলাকায় অনেকেই ভিক্ষা করে টাকা জুগিয়েছেন। আবার অনেকে বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কাজ করে টাকা জুগিয়ে সেই টাকায় মেহেদি-নতুন পোশাক কিনেছেন। আমরা পন্টুনে ঘুমালেও ঈদতো আনন্দের। সেজন্য ঈদের প্রস্তুতি ছিল অনেক আগে থেকে। সবাই নিজের মত করে তৈরি হচ্ছে।

মেহেদী লাগাতে ব্যস্ত নয়নমনি বলেন, টাকা থাকলেই ঈদ হয় এই কথা মিথ্যা। আমাদের ঈদ এভাবেই কাটে প্রতি বছর।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর