প্রতিবন্ধীদের অনেকেই সমাজের বোঝা মনে করেন, এমনকি পরিবারের লোকজনও। সেই প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেছে বাক ও শ্রবন প্রতিবন্ধী অনন্যা খাতুন। একজন বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী মেয়ে হয়েও কর্মদক্ষতা দেখিয়ে সমাজ সেবা মন্ত্রনালয় থেকে সফল প্রতিবন্ধীর শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার লুফে নিয়ে এলাকাবাসীর প্রশংসায় ভাসছে অনন্যা।

প্রতিবন্ধী অনন্যা খাতুন সমাজের কাছে এক অনন্য স্থাপন করেছে। অনন্যা মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার বামুন্দী ইউনিয়নের নিশিপুর গ্রামের ইটভাটা শ্রমিক আলামিন হোসেনের মেয়ে ও স্থানীয় বাওট বাধাগ্রস্থ শিশু বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেনীর ছাত্রী।

জানা গেছে, ৩৩ তম আন্তার্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস ও ২৬তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস-২০২৪ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সমাজ কল্যাণ মন্ত্রনালয় থেকে সফল প্রতিবন্ধী হিসেবে ষষ্ঠতম পুরুস্কার,সম্মাননা ক্রেস্ট ও সনদ পত্র পায়। ৪ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে পুরস্কৃত হয়ে গত শনিবার গ্রামে ফিরেছে অনন্যা।

অনন্যা খাতুনের মা ইয়াসমিন খাতুন বলেন, “আমার দুই মেয়ে। বড় মেয়ে অন্তরা খাতুন,ছোট মেয়ের নাম অনন্যা খাতুন। ২০০৯ সালে অনন্যা ভুমিস্ট হয়।  জন্মের কয়েক বছর পর থেকে তার এই অবস্থা। পরে তাকে বেশ কয়েকজন শিশু বিশেষঞ চিকিৎসককে দেখালে চিকিৎসকরা  বলেছিলেন অনন্যা জন্মগত ভাবেই বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী।”

“একথা শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। একে তো মেয়ে,তারপর আবার প্রতিবন্ধী। তাকে নিয়ে পড়ি মহাবিপাকে। প্রতিবেশীরাও অনন্যাকে নিয়ে অনেক কটুকথা বলতো। অনন্যার বয়স ৫ বছর  হলে গ্রামের ব্র্যাক স্কুলে প্লেতে ভর্তি করি। গ্রামের অনেকেই বলতো প্রতিবন্ধী মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে বা কাজ শিখিয়ে কি হবে?”

ইয়াসমিন খাতুন বলেন, অনন্যাকে ইশারা ইঙ্গিতে সব বোঝাতে হতো। তবে মুখে কথা বলতে এবং কানে শুনতে না পেলেও তার স্মরনশক্তি ভাল মনে হতো। বাংলা পড়া ও লেখার পাশাপাশি আরবি পড়া শুরু করে। এক বছর পর সে কোরআন শরিফ পড়তে পারে।

পরে ব্র্যাক স্কুল থেকে নিয়ে স্থানীয় বাওট বাধাগ্রস্ত শিশু বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয় অনন্যাকে। সেখানে লেখাপড়ার পাশাপাশি দর্জি প্রশিক্ষণ দেন শিক্ষকরা।  অনন্যা এখন পড়ালেখার পাশাপাশি সেলাইমেশিনে কাজ করে। নারীদের পোশাকের পাশাপাশি সিমেন্টের পরিত্যাক্ত বস্তার ব্যাগ তৈরি করে বিক্রি করে  অভাবের সংসারে আর্থিক যোগান দিচ্ছে। প্রতিটি ব্যাগ তৈরীতে খরচ হয় ৫ টাকা। পাইকাররা নিয়ে যায় ৮ টাকা দরে। প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ টি ব্যাগ তৈরী করতে পারে অনন্যা।

ইয়াসমিন খাতুন বলেন, যা ছেলেরা করে দেখাতে পারনি আমার প্রতিবন্ধী মেয়ে করে দেখিয়ে দিয়েছে। অনন্যা আমার পরিবারের গর্ব।যারা অনন্যাকে নিয়ে কটু কথা বলতো তারাই আজ অনন্যার অর্জনকে গর্ববোধ করছে। এলাকার বিভিন্ন মানুষ আসছে অনন্যাকে দেয়া পুরুস্কার দেখতে।

অনন্যার বড়বোন অন্তরা খাতুন বলেন, “আমি দশ ক্লাশ পড়াশোনা করেছি। তারপর আমার বিয়ে হয়ে যায়। আমার বাবা মায়ের অনেক স্বপ্ন ছিল। আমি সে স্বপ্ন পূরণ করতে পারিনি। আমার ছোটবোন অনন্যা প্রতিবন্ধী হলেও মনে হচ্ছে বাবা মায়ের স্বপ্ন পূরণ করবে, সংসারের হাল ধরবে।”

অন্তরা আরও বলেন, “অন্তরা প্রতিবন্ধী হলেও সে অনেক মেধাবী। সে ছবি আঁকতে পারে,মোবাইল চালাতে পারে, সব কাজই সে করতে পারে স্বাভাবিক মানুষের মতো।

অনন্যার বাবা আল আমিন হোসেন জানান, “আমি একজন দিনমজুর। ইট ভাটায় কাজ করে সংসার চলতো আমার। কিন্তু অনন্যা সেলাই মেশিনে পোশাক বানিয়ে এবং ব্যাগ তৈরি করে ভাল টাকা আয় করে সংসারে আর্থিক সহায়তা করছে। প্রতিবন্ধী ও নারী সন্তান বলে মন খারাপ করিনা। প্রতিবন্ধী মেয়ে আমার বোঝা নয়,বরং পরিচর্যা ও মেধা বিকাশের সুযোগ করে দিতে পারলে এরাও অনেক কিছু জয় করবে।”

দাদি জালেমিনা বলেন, গ্রামের সব লোক বলতো প্রতিবন্ধী মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে কি হবে। তারাই আজ অনন্যাকে নিয়ে গর্ব করছে। লেখাপড়া, সেলাই কাজ করেও অনন্যা  মায়ের সাথে সংসারে সব কাজ করতে পারে।

বাওট বাধাগ্রস্ত শিশু বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এনামুল হক জানান, “অনন্যা আগে কিছুই পারতোনা। আমরা তাকে ইশারা ইঙ্গিতে লেখাপড়ার পাশাপাশি সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়েছি। সে এখন সেলাইয়ের সব কাজ করতে পারে।  সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দেয়া সম্মাননা অন্যান্যদেরও উদ্বুদ্ধ করবে।”

গাংনী উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা মোহাম্মদ আরশাদ আলী বলেন, “অনন্যা খাতুনের প্রতিভা দেখে আমরা মন্ত্রনালয়ে তালিকা প্রেরন করি।  সেখানে সে কর্মদক্ষতায় দেশ সেরা সফল প্রতিবন্ধী নারী হিসেবে স্বিকৃতি পেয়েছে। তার অনেক মেধা আছে,আরও ভাল কিছু করবে এমনটা প্রত্যাশা করি।”

“তিনি আরও বলেন,প্রতিবন্ধী বলে কোন সন্তানকে বোঝা মনে না করে তাদেরও মেধা বিকাশের সুযোগ রয়েছে। সরকারের সকল সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রতিবন্ধীদেকেও কর্মদক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার চেস্টা থাকলে এরাও সমাজকে কিছু দিতে পারবে।”

আকতারুজ্জামান/এসএমডব্লিউ