গুচ্ছমূলের গাছ ‘চাম্বল’। উপকূলের এমন কোনো বাড়ি নেই যে বাড়িতে এ গাছের দেখা মেলে না। অধিক লাভের আশায় দ্রুত বর্ধনশীল এই গাছ রোপণ করা হয়। কিন্তু ঝড় জলোচ্ছ্বাসে উপকূলে এখন মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে এই চাম্বল গাছ।

উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের দক্ষিণের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতি বছরই হানা দেয় কোনো না কোনো ঘূর্ণিঝড়। এছাড়াও নিম্নচাপ ও লঘুচাপ তো আছেই। এসব ঝড়ে সবার আগে উপড়ে পড়ে চাম্বল গাছ। এতে ঘর বিধ্বস্তের পাশাপাশি বৈদ্যুতিক লাইন ক্ষতিগ্রস্ত, সড়ক ও নৌ যোগাযোগ বন্ধ এবং প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে।

বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চাম্বল মূলত একটি গুচ্ছমূলের গাছ। এর শিকড় মাটির উপরিভাগে গুচ্ছ আকারে থাকে। শিকড় মাটির গভীরে যায় না। ফলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে এটি খুব সহজে উপড়ে পড়ে। চাম্বল প্রচুর রস শুষে নিয়ে মাটিকে অনুর্বর করে তোলে। এ গাছ খুব লম্বা হয় ও দ্রুত বাড়ে। ফলে মানুষ লাভের আশায় চাম্বল গাছ রোপণ করে। তবে এই গাছ উপকূলের মাটির উপযোগী নয়।

পিরোজপুরের বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের তাণ্ডবে পিরোজপুরে শুধু চাম্বল গাছ চাপায় ছয়শ ঘর বিধ্বস্ত হয়। এছাড়াও এই গাছ উপড়ে বিদ্যুতের তার ছেঁড়াসহ সড়কপথের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়াও ২০০৭ সালে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলায় ১৭১ জনের প্রাণহানি ঘটে চাম্বল গাছ চাপায়।

বরগুনা সদর উপজেলার সদর ইউনিয়নের হেউলিবুনিয়া এলাকার আব্দুল লতিফ বলেন, ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরে আমাদের এই এলাকার অন্তত ১৭ জন চাম্বল গাছের নিচে চাপা পড়ে মারা যান। এছাড়াও আমাদের এলাকায় অসংখ্য বাড়িঘর চাম্বল গাছের চাপায় বিধ্বস্ত হয়।

বরগুনা সদর উপজেলার বদরখালী ইউনিয়নের বাওলকর এলাকার বাসিন্দা হেমায়েত উদ্দিন বলেন, সিডরের সময় যখন জলোচ্ছ্বাস শুরু হয় তখন আমরা বেড়িবাঁধের ওপর আশ্রয় নিই। এ সময় ঝড়ো বাতাসে উপড়ে পড়া একটি চাম্বল গাছের নিচে চাপা পড়ে আমার ভাই মারা যায়। আর আমাদের ঘর চাম্বল গাছের চাপায় বিধ্বস্ত হলেও পরে জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায়।

বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার বাসিন্দা মোতালেব মোল্লা বলেন, ঘরের পাশে একটি চাম্বল গাছ ছিল। নতুন ঘর তুলবো বলে গাছটা রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের সময় ওই গাছ আমার ঘরের ওপর উপড়ে পড়ে। এতে ঘরটি দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। আমরা কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে যাই। 

বরগুনার ডি কে পি রোডের বাসিন্দা হাফিজুর রহমান সালেক বলেন, আমার বাসা চারপাশ দিয়ে প্রাচীরে ঘেরা। বাসার মধ্যে বিশাল আকৃতির বেশ কয়েকটি চাম্বল গাছ ছিল। ১৯৯৭ সালের বন্যায় চাম্বল গাছগুলো সব উপড়ে পড়ে এবং ভেঙে যায়। ভাগ্য ভালো বলে একটি গাছও কোনো ঘরের ওপর পড়েনি। তাহলে নিশ্চিত প্রাণহানির ঘটনা ঘটতো। তবে চাম্বল গাছ উপড়ে পড়ায় বৈদ্যুতিক লাইন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বলেও জানান তিনি।

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার তরুণ পরিবেশবিদ আহসান উল্লাহ বলেন, চাম্বল গাছ আমাদের মাটি এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। ঝড় জলোচ্ছ্বাসে চাম্বল গাছ প্রাণহানির কারণ হয়েও দাঁড়ায়। বছর চল্লিশেক আগে উপকূলে এ গাছের আগমন ঘটে। এক সময় নার্সারিতে মাটির টালিতে এ গাছের চারা উৎপাদন করে বিক্রি করা হতো। এই গাছ যত কম লাগানো যায় ততই আমাদের জন্য মঙ্গল।

এ বিষয়ে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মিহির কুমার দো বলেন, যেসব গাছ ঘরের আশেপাশে লাগাতে আমরা নিরুৎসাহিত করি তার মধ্যে অন্যতম চাম্বল গাছ। ঝড় জলোচ্ছ্বাসে এ
গাছ সবার আগে উপড়ে পড়ে।

ঝড়ে এ গাছ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় জানিয়ে তিনি বলেন, ঝড় জলোচ্ছ্বাসের সময় গাছ আমাদের পরম বন্ধু হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু চাম্বল গাছ আমাদের সঙ্গে শত্রুর মতোই আচরণ করে। তাই ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় চাম্বল গাছ রোপণ করাকে নিরুৎসাহিত করেন তিনি।

এ বিষয়ে বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় আমরা ইতিমধ্যেই প্রস্তুতি সভা সম্পন্ন করেছি। জেলার সকল দফতর একযোগে সমন্বিতভাবে কাজ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি রোধে ইতোমধ্যে আমরা যেসব নির্দেশনা প্রদান করেছি তার মধ্যে গাছের ডালপালা কেটে ফেলা অন্যতম।

ঘরের আশেপাশের বড় গাছের ডালপালা কেটে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ঘরের পাশের গাছের ডালপালা কেটে ফেললে সেই গাছ উপড়ে ঘরের ওপর পড়ার সম্ভাবনা কম থাকে। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কম হয়।

আরএআর