লিচুর কথা শুনতেই জিভে আসে জল। যদি সেটা দিনাজপুরের বেদানা কিংবা চায়না-থ্রি জাতের লিচু হয় তাহলে তো কথাই নেই। এখানকার লিচু মানেই খোসার ভেতরে রসে টইটম্বুর। খোসা ছাড়িয়ে মুখে দিতেই যেন অমৃত। গাছে গাছে ঝুলে থাকা লাল টসটসে সেই লিচু এখন দিনাজপুরের গোড়-এ-শহীদ ময়দানের পাইকারি বাজারে। তবে আবহাওয়ার কারণে এবার লিচুর ফলন কম হয়েছে।

লিচুর রঙে রঙিন হতে শুরু করেছে চাষির মন। আনন্দে দোল খায়, চওড়া হতে থাকে লিচুচাষির মুখের হাসি। কয়েক দিন ধরে লিচু পাড়া, বাছাই করা, ঝুড়িতে সাজানো, পাইকারি বাজারে এনে বিক্রি করা সব মিলিয়ে যেন লাল রঙের উৎসব। বাজারে এসেছে টসটসে লিচু।

লিচুচাষি আর বাগান মালিকরা নিয়ে লিচু আনছেন আড়তে। দর কষাকষি চলছে পাইকারদের সঙ্গে। অবশেষে পাইকাররা লিচু কিনছেন, খাঁচায় ভরছেন, ট্রাকে লোড করা হচ্ছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে চলে যাচ্ছে। তবে তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে এবারে অন্তত ৩০ শতাংশ লিচুর ফলন কমেছে। ফলন কমলেও চাহিদার আধিক্যে লিচুর বাজার খানিকটা চলতি সময়ের উষ্ণতা ছড়ানোর মতো।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, দিনাজপুরে ২০২০-২১ মৌসুমে ৫ হাজার ৪৮১ হেক্টর জমিতে এবার লিচুর চাষ হয়েছে। এ বছর লিচুর লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রতি হেক্টরে ৪.৯৭ মেট্রিক টন। এসব বাগানে ৩ লাখ ৩০ হাজার ৬৩টি গাছ রয়েছে। ছোট-বড় বাগান রয়েছে ৩২ হাজার।

২০১৮-১৯ মৌসুমে ৫ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমির বিপরীতে উৎপাদন হয়েছিল ২৬ হাজার ৪৮ মেট্রিক টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৫ হাজার ৬১০ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছিল ৩৩ হাজার ৪৮৪ টন। প্রতি বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকার বেচাকেনা হয় লিচুর মৌসুমে।

দিনাজপুর শহরের সবচেয়ে বড় লিচুর বাজার কালীতলা থেকে গোর-এ-শহীদ বড় ঈদগাহ ময়দানে স্থানান্তর করা হয়েছে। করোনার এই পরিবেশে ব্যবসায়ীরা ও কৃষকগণ যেন সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সামাজিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিচালনা করতে পারে সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন দিনাজপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাকী।

আড়তদার কমিটির সভাপতি রুস্তম বলেন, জেলা প্রশাসক করোনার জন্য এবারো বড় মাঠে স্থানান্তর করেছেন। এখানকার জায়গা ফাকা, কোনো রকমের ভিড় নেই। দূরত্ব বজায় রেখে লিচু বিক্রি করা হচ্ছে। ফলন কম হওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী অলস সময় পার করছেন। খুচরা বাজারে ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। বাজারে এসেছে মাদ্রাজি, বেদানা ও চায়না-থ্রি জাতের লিচু। তবে বোম্বাই ও চায়না-থ্রি কিছুটা কম।

পাইকারি বাজারে বিক্রি করেতে আসা লিচুচাষি গোপাল দেব বলেন, আমার দশটা বাগান আছে। অন্য বছর থেকে এবার ফলন খুব কম হয়েছে। আংশিক গাছে শুধু ফলন হয়েছে। বাগানে যা খরচ হয়েছে তা থেকে কিছুটা লাভ হবে। বর্তমানে বাজার খুব ভালো। অন্য বছর এই সময় যেখানে আমি ১৫ থেকে ১৭শ টাকা হাজার বিক্রি করতাম সেখানে আজ আমি ২২শ টাকা করে বিক্রি করেছি।

জানা যায়, বর্তমানে মাদ্রাজি জাতের প্রতি ১০০ লিচু বিক্রি হচ্ছে ১৮০-৩০০ টাকায়। বেদানা জাতের ১০০ লিচু বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৭০০ টাকা দরে আর চায়না-থ্রি লিচু বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ১১শ টাকায়। পাইকারি বাজারে মাদ্রাজি লিচু প্রতি হাজারে বিক্রি হচ্ছে ১২শ থেকে ২২শ টাকা পর্যন্ত। বেদানা লিচু বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। চায়না-থ্রি লিচু ৪ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত।
 
লিচুর ফলন কম হওয়ার কারণ জানতে চাইলে উদ্যানতত্ত্ববিদ দিনাজপুর হটিকালচার সেন্টারে উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) নয়ন কুমার শাহ বলেন, গত বছর কিন্তু লিচু বাম্পার ফলন হয়েছিল। এই ফলনের পরে যে হারে গাছে খাবার দেওয়া দরকার ও ফল গাছের ব্যবস্থাপনা করা দরকার তা দেওয়া হয়নি এবং এ বছর আবহাওয়ার তারতম্য হয়ছে।

তিনি আরও বলেন, ফল উৎপাদনের জন্য কার্বন ও নাইট্রোজেনের অভাব দেখা দেওয়ার ফলে গাছে মুকুল আসে না। উৎপাদন কম হয়ে যায়। যদি কোনো বছর বেশি উৎপাদন হয় তার পরের বছর গাছের প্রচুর খাদ্যের অভাব থাকে। ফলে উৎপাদনের ব্যাঘাত ঘটে। এ বছর বৃষ্টি কম হওয়ায় ফলন কম হয়েছে।

এমএসআর