শ্যামাসুন্দরী খাল পুনরুদ্ধারে আদালতের নির্দেশ
রংপুর জেলার ঐতিহ্যবাহী শ্যামাসুন্দরী (স্ক্রাইন) খাল দূষণ ও দখল থেকে রক্ষায় বিবাদীগণের ব্যর্থতা সংবিধান ও প্রচলিত আইনের লঙ্ঘন হওয়ায় কেন তা অসাংবিধানিক, বেআইনি এবং বিধিবহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগ বিবাদীগণের ওপর রুল জারি করেছেন। জারিকৃত এই রুলে সিএস জরিপ ও মূল প্রবাহ অনুযায়ী উল্লেখিত খালের সীমানা নির্ধারণের, স্থানীয় বাসিন্দাদের চাষাবাদ ও মৎস্য শিকারের অধিকার সুরক্ষা করতে এবং তাদের জীবন ও জীবিকার মান উন্নয়ন করতে খাল থেকে দখলদার উচ্ছেদ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ করে খালটি পুনরুদ্ধারপূর্বক পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে এনে যথাযথ সংরক্ষণ করার নির্দেশ কেন প্রদান করা হবে না, তাও জানতে চেয়েছেন মহামান্য আদালত।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) কর্তৃক দায়েরকৃত একটি জনস্বার্থমূলক (নং ১৫৫৭১/২০২৪) মামলার প্রাথমিক শুনানি শেষে সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব এবং বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বিভাগের ডিভিশন বেঞ্চ এ আদেশ প্রদান করেন।
বিজ্ঞাপন
রুল জারির পাশাপাশি মহামান্য আদালত উল্লিখিত খালের মূল প্রবাহ অনুযায়ী সীমানা নির্ধারণ, দখলদার উচ্ছেদ, দূষণের উৎস চিহ্নিতকরণ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও খালের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করে খাল পুনরুদ্ধার করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা প্রতিবেদন আকারে আদালতে তিন মাসের মধ্যে দাখিলের নির্দেশ প্রদান করেছেন। আদালতের আদেশ পালন-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য রংপুরের জেলা প্রশাসক, রংপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক, রংপুর পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ও রংপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালককে নির্দেশ প্রদান করেছেন।
মামলার বিবাদীগণ হলেন—পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক, রংপুরের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, রংপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক, রংপুর পানি উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী, রংপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক এবং রংপুর সদরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
বিজ্ঞাপন
বেলার পক্ষে মামলাটি পরিচালনাকারী অ্যাডভোকেট এস. হাসানুল বান্না এই রায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, তাকে এ মামলায় সহযোগিতা করেছেন অ্যাডভোকেট তৌহিদুল আলম। রাষ্ট্রপক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তানিম খান।
উল্লেখ্য, রংপুর জেলার কেল্লাবন্দ এলাকায় শ্যামাসুন্দরী (স্ক্রাইন) খাল নামক একটি ঐতিহ্যবাহী খাল রয়েছে যার আয়তন প্রায় ১৬ বর্গকিলোমিটার (৪১.৩৯৭১ একর)। খালটি রংপুর সদর উপজেলার কেল্লাবন্দ মৌজায় ঘাঘট নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে নগরীর রঘুনাথ, ভগী, রাধাবল্লভ, আলমনগর, কামালকাছনা, মাহিগঞ্জ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মাহিগঞ্জ রেলব্রিজের পাশে খোকসা ঘাঘট নদীতে পতিত হয়ে পুনরায় ঘাঘট নদীতে মিলিত হয়েছে।
খালটি দখল করে গড়ে উঠেছে দোকান, ঘর-বাড়িসহ নানা অবৈধ স্থাপনা। নির্মিত এসব স্থাপনার জন্য খাল সংকুচিত হয়ে পানি প্রবাহের মূলধারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দখলের পাশাপাশি দূষণেও জর্জরিত এ খাল। খালটির বিভিন্ন স্থানে ড্রেনের মাধ্যমে নিষ্কাশিত তরল বর্জ্য, প্লাস্টিক, পলিথিন, পয়ঃবর্জ্য, গৃহস্থালি বর্জ্য দ্বারা খালের পানি দূষিত হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে খালটি প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে একটি পচা ডোবায় পরিণত হয়েছে। হারিয়ে গেছে মাছসহ জলজ প্রাণী এবং পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হয়েছে খাল নির্ভর কৃষক ও মৎস্যজীবীগণ।
শহরের পানি নিষ্কাশনে অন্যতম প্রধান মাধ্যম শ্যামাসুন্দরী খাল দখল ও দূষণ থেকে রক্ষায় বেলা উল্লিখিত জনস্বার্থমূলক মামলাটি দায়ের করে।
এদিকে রায়কে স্বাগত জানিয়ে পরিবেশ সংগঠক ও শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, বর্তমানে শ্যামাসুন্দরীকে বাঁচাতে হলে এতে পানি লাগবে। ৩০ বছর আগে কীভাবে পানি প্রবাহিত হতো, ঘাঘট থেকে শ্যামাসুন্দরীতে কেন পানি প্রবাহিত হচ্ছে না, কোথায় কোথায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে তা আমাদের চিহ্নিত করতে হবে। বর্তমানে রংপুর শহরের আকাশ খারাপ হলে গোটা নগরী পানিতে ডুবে যাবে, যা দুই বছর থেকে আমরা বুঝতে পারছি। অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে হবে এবং এ খালে পানির প্রবাহ যেন স্বচ্ছ থাকে সে ব্যাপারেও অধিকতর নজর দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, নদী রক্ষকরা শ্যামাসুন্দরীর কান্না দেখেও না দেখার ভান করে। তাদের সামনে শ্যামাসুন্দরী দখল হচ্ছে, দূষিত হচ্ছে। মাত্র ৪ কোটি টাকা হলে তিন মাসের মধ্যে শ্যামাসুন্দরীর দখল উচ্ছেদপূর্বক এর দূষণ দূর করা সম্ভব। প্রথমে চাই নদীর সুরক্ষা তারপর এর সৌন্দর্যবর্ধন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রংপুর মহানগর সভাপতি খন্দকার ফখরুল আনাম বেঞ্জু বলেন, পরিকল্পনা মাফিক কোনো উন্নয়নকাজ না হওয়ায় শ্যামাসুন্দরী খালটি ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এক সময়ের ৬০ ফুট চওড়া খালটি বর্তমানে ১০ থেকে ১৫ ফুটে এসে ঠেকেছে। খালের বেশির ভাগই দখল করে নিয়েছে প্রভাবশালী লোকজন। আবার কোথাও কোথাও ভরাট হয়ে গেছে ময়লা-আবর্জনায়। এখন আদালতের নির্দেশনা যদি বাস্তবায়ন হয়, তাহলে খালের প্রাণ ফেরানোর প্রথম প্রচেষ্টা সার্থক হবে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এএমকে