বাইক কিংবা গাড়িতে ছুটে চলছেন। হঠাৎ যখন রাস্তার দুই পাশে চোখ পড়বে তখন মনে হবে আপনি লাল-হলুদের গালিচার মাঝ দিয়ে যাচ্ছেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলা কিশোরগঞ্জের ‘হাওরের বিস্ময়’ হিসেবে পরিচিত ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম ‘অল-ওয়েদার’ সড়কে এমন দৃশ্যই দেখা যাবে। 

বর্ষায় যখন এই ‘অল-ওয়েদার’ সড়কে চলবেন তখন মনে হবে আপনি হয়তো সাগরের মাঝ দিয়ে কোনো রাস্তায় চলছেন। আবার বোরো মৌসমে যখন চলবেন তখন মনে হবে আপনি হয়তো কোনো সবুজের মাঝখান দিয়ে পথ চলছেন। আর এখন যদি আপনি ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম অল-ওয়েদার সড়ক দিয়ে চলেন তখন মনে হবে আপনি লাল-হলুদের গালিচার মাঝ দিয়ে যাচ্ছেন। 

সড়কের দুই পাশে শুকাতে দেওয়া লাল টকটকে মরিচ ও হলুদ ভুট্টা যেন সড়কের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। অল-ওয়েদার সড়কের দুই পাশে চোখে পড়বে এমন লাল ও হলুদ রঙের সমারোহ। মনে হবে যেন পিচঢালা কালো সড়কের সৌন্দর্য বাড়াতেই লাল-হলুদের এমন গালিচা কেউ তৈরি করে রেখেছে। 

হাওরের জমি থেকে অনেক উঁচু এই সড়কে অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই ট্রাকসহ ভারী যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাই হাওরের লোকজন বোরো ধান পরিবহনের পাশাপাশি সড়কের দুই পাশে রোদে শুকাতে দিয়েছেন হাওরের জমিতে উৎপাদিত মরিচ ও ভুট্টা। মরিচের লাল রং ও ভুট্টার হলুদ রঙ নান্দনিক এ সড়কের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। হাওরে বাড়ির পাশে উঁচু ও প্রশস্ত এমন মনোরম পরিবেশে জমির ফসল শুকাতে পেরে খুশি স্থানীয়রা। 

কিশোরগঞ্জের গভীর হাওরের তিন উপজেলা ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রামের মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের জন্য তৈরি করা নান্দনিক এই সড়ক এখন সব মৌসুমেই সৌন্দর্য পিপাসুদের কাছে হয়ে উঠেছে আকর্ষণীয়। এর ফলে কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকায় পর্যটনের অপার সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচিত হয়েছে।

হাওরবাসীর কষ্ট লাঘবে এ সড়ক নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন ‘ভাটির শার্দুল’ রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের অভিপ্রায় অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে জেলার তিন হাওর উপজেলার মধ্যে সারা বছর চলাচলের জন্য সড়ক ও জনপথ অধিদফতর কর্তৃক এই সড়ক নির্মাণ প্রকল্প গৃহীত হয়। ২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ আনুষ্ঠানিকভাবে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক প্রকল্পের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন।

২০২০ সালের ৮ অক্টোবর গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি হাওর উপজেলা ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের সঙ্গে যুক্ত অল-ওয়েদার সড়কের উদ্বোধন করেন।

মিঠামইন হাওরের কুষক মাজিদ উদ্দিন বলেন, আমরা হাওরবাসী কোনো দিন স্বপ্নেও ভাবিনি এমন সড়ক হাওরে হবে। এই সড়ক এখন আমাদের জন্য ভাগ্য বদলের হাতিয়ার হয়েছে। আগে আমাদের কোনো পণ্য এই শুকনো মৌসমে শহরে পাঠাতে অনেক কষ্ট হতো। বোরো ধান, মরিচ ও ভুট্টা শুকাতেও অনেক কষ্ট হতো। তবে এখন মরিচ-ভুট্টা শুকানোর জন্য সকালে রোদে দিয়ে বিকেলেই ভালো করে শুকানোর পর সড়ক থেকে বাড়িতে নিতে পারি। 

মশিউর রহমান আকন্দ নামে এক পর্যটক বলেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি অপরূপ সৌন্দর্যের হাওর দেখে আমরা বিমোহিত। বর্ষায় এই হাওরের এক রূপ আর শুকনো মৌসুমে আরেক রূপ। গত বর্ষায় আমি হাওর দেখতে এসেছি। সেসময় এই রাস্তাকে মনে হয়েছে সমুদ্রের মাঝ দিয়ে হারিয়ে যাওয়া কোনো এক রাস্তা। আর এখন মনে হচ্ছে সবুজের সমারোহের মধ্যে দিয়ে লাল-সবুজের গালিচার রাস্তা। শহরে এতো সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা যায় না। তাই কিছু সময়ের জন্য প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে হাওরে এসেছি। মানসিক প্রশান্তির জন্য সবার উচিত এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা। তাতে মন ও শরীর উভয়ই ভালো থাকে।

মিঠামইন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রভাংশু সোম মহান বলেন, এই অল-ওয়েদার সড়ক নির্মাণ হওয়ায় হাওরের মানুষের নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা এত দ্রুত বদলে যাবে, তা কেউ কল্পনাও করেনি কোনো দিন। আগে এখানকার অনেক মানুষ দিনে ৫০০ টাকা আয় করতে পারতেন না। অথচ এখন একই ব্যক্তি দিনে কমপক্ষে দুই হাজার টাকা আয় করছেন।

কিশোরগঞ্জ সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাশেদুল আলম জানান, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অধীনে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর ৮৭৪.০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। ২৯.৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই অলওয়েদার সড়কে ৫৯০.৪৭ মিটার দীর্ঘ তিনটি পিসি গার্ডার, ১৯০ মিটার দীর্ঘ ৬২টি আরসিসি বক্স কালভার্ট, ২৬৯.৬৮ মিটার দীর্ঘ ১১টি আরসিসি গার্ডার সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ৭.৬০ লাখ বর্গমিটার সিসি ব্লক দিয়ে স্লোপ প্রটেকশনের কাজ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৬১.৮১ মিটার দীর্ঘ ভাতশালা সেতু, ১৭১.৯৬৪ মিটার ঢাকী সেতু এবং ১৫৬.৭২ মিটার দীর্ঘ ছিলনী সেতু- এ তিনটি সেতু সড়কটির সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (খামার বাড়ি) উপপরিচালক সাইফুল আলম বলেন, হাওরে এই মৌসুমে কৃষকরা ফসল শুকাতে অনেক বিড়ম্বনার শিকার হতেন। নতুন এ অল-ওয়েদার সড়ক নির্মাণ হওয়ায় তারা সহজেই জমির ফসল শুকাতে পারছেন। 

তিনি আরও বলেন, এবার জেলায় সাড়ে ৭ হাজার হেক্টর জমিতে ভুট্টা এবং সাড়ে চার হাজার হেক্টর জমিতে মরিচের আবাদ হয়েছে। এ বছর জেলায় মরিচ ও ভুট্টার ফলনও অনেক ভালো হয়েছে।

এসকে রাসেল/আরএআর