৪০০ বছরের পুরোনো পোড়াদহ মেলা
১৫ কেজির এক মিষ্টির দাম ৯ হাজার
বগুড়ার গাবতলীতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী পোড়াদহ মেলা। ৪০০ বছরের পুরোনো এই মেলার নামকরণ করা হয়েছে পোড়াদহ গ্রামের নামানুসারেই। মেলা উপলক্ষে পূর্ব বগুড়ার প্রায় পাঁচটি উপজেলার প্রতিটি মোড়ে বসেছে মাছ ও মিষ্টির দোকান। জেলাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পোড়াদহ মেলার আমেজ। বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) গাবতলী উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নের পোড়াদহ এলাকায় এক দিনব্যাপী এই মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়। বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে মাঘ মাসের শেষ বুধবার আয়োজন করা হয় মেলার।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মেলায় বাহারি রকমের কসমেটিকস, খেলনা, গিফট সামগ্রী, চুড়ি, কানের দুল, মালা, কাজল, মেকআপ বক্স, ব্যাট, বল, নাগরদোলা, মোটরসাইকেল রেস, জাদু খেলাসহ নানা ধরনের প্রসাধনী ও খেলনা সামগ্রী নিয়ে বসেছেন দোকানিরা। এ ছাড়া মেলায় পাওয়া যায় কাঠের, স্টিল ও লোহার বিভিন্ন আসবাবপত্র।
বিজ্ঞাপন
মাছে-ভাতে বাঙালি, তাই মাছ নিয়ে অন্যরকম এক আবেগ আছে বাঙালির মাঝে। তাই রুই, কাতলা, বোয়াল, চিতল পাঙাশসহ হরেক রকমের মাছ ওঠে এই মেলায়। ২০২২ সালের আগ পর্যন্ত মেলায় সবচেয়ে বড় মাছের তালিকায় নাম থাকতো বাঘাড়ের। মহাবিপন্ন প্রজাতির প্রাণী বলে ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ হলেও এ বছর মেলায় ছোট ও মাঝারি আকৃতির বাঘাড় মাছের দেখা মিলেছে।
বিজ্ঞাপন
এ ছাড়া মেলার প্রধান আকর্ষণ মাছ আর মিষ্টি, এই দুইয়ের সমন্বয়ে আবার মাছ মিষ্টি। তাই মিষ্টির প্রতি আকর্ষণ বাড়াতে মাছের আকৃতিতে মিষ্টি তৈরি করেছেন এখানকার কারিগররা। মেলায় সবচেয়ে বড় মিষ্টি উঠেছে ১৫ কেজি ওজনের, যা বিক্রি হয়েছে ৯ হাজার টাকায়। এ ছাড়া ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের মাছ আকৃতির সাদা মিষ্টি, কালো মিষ্টি, গোলাপ জাম, পানতুয়া, মরিস মিষ্টিসহ আরেক রকমের মিষ্টি উঠেছে এই মেলায়। এ মেলায় ২০০ টাকা থেকে শুরু করে ৬০০ টাকা কেজিতেও বিক্রি হচ্ছে মিষ্টি।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রায় ৪০০ বছর আগে এই স্থানে একটি বট গাছ ছিল। এক দিন হঠাৎ করেই সেখানে এক সন্ন্যাসীর আবির্ভাব হয়। তারপর সেখানে দলে দলে সন্ন্যাসীরা এসে একটি আশ্রম তৈরি করেন। এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে জায়গাটি পূণ্যস্থানে পরিণত হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন সেখানে প্রতিবছর মাঘ মাসের শেষ বুধবার সন্ন্যাসী পূজার আয়োজন করে। আর এই সন্ন্যাসী পূজাকে ঘিরেই এই মেলার উৎপত্তি। এক সময় সন্ন্যাসীরা স্থানটি ত্যাগ করে চলে গেলেও সন্ন্যাসী পূজাটি অব্যাহত থাকে। তারপর ধীরে ধীরে মেলার পরিচিতি বাড়তে থাকে।
মেলায় আসা মহিষাবান ইউনিয়নের বাসিন্দা আব্দুস সালাম বলেন, ঈদ বা অন্য কোনো উৎসবে জামাই-মেয়েসহ অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত না দিলেও তেমন কোনো সমস্যা নেই। তবে মেলা উপলক্ষে দাওয়াত দিতেই হবে, যা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যে এলাকার প্রতিটি বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন এসেছেন। মেলার কয়েক দিন পর্যন্ত ধুমধাম চলবে। মেলাটি এক দিনের হলেও অত্র এলাকায় মেলার আমেজ থাকে সপ্তাহব্যাপী।
মাছ বিক্রেতা আব্দুল লতিফ বলেন, আমি প্রায় ২০ বছর যাবত এই মেলায় দোকান বসাই। সপ্তাহখানেক আগে আমরা এই জায়গা নির্ধারণ করেছি। মেলাকে ঘিরে প্রায় সপ্তাহখানেক আগে আমরা মাছ সংগ্রহ করি। বগুড়ার স্থানীয় নদীসহ দেশের বিভিন্ন আড়ত থেকে মাছ ক্রয় করে মেলায় বিক্রি করি। আমি ৭ থেকে ১০ কেজি ওজনের সিলভর বিক্রি করছি ৪০০ টাকা কেজি প্রতি। ৪ থেকে ৫ কেজি ওজনের রুই ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা কেজিতে। এ ছাড়া এই মেলায়, কাতলা প্রতি কেজি ৬০০ থেকে ৭০০, বোয়াল ১৬০০ থেকে ১৮০০ টাকা, চিতল প্রতি কেজি ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকা এবং বাঘাড় প্রতি কেজি ১২০০ থেকে ১৮০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
মেলা উপলক্ষে শ্বশুরবাড়ি ঘুরতে আসা নতুন জামাই রফিক বলেন, আমার বাড়ি দিনাজপুর শহরে। আমি এই প্রথম মেলাতে এসেছি। এই পোড়াদহ মেলাতে আসার আগে মেলা সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছি তা আজ বাস্তবে দেখলাম। সকালে আমার শ্বশুর আমাকে মেলা উপলক্ষে ১০ হাজার টাকা দিয়েছে। আমি মেলায় এসে কাতলা মাছ কিনেছি ১২ কেজি ওজনের।
ঠাকুরগাঁ থেকে ঘুরতে আসা একটি পরিবার জানায়, এত মাছ একসঙ্গে দেখব এটা কখনো ভাবিনি। আমি আমার শ্বশুর-শাশুড়ি ছেলে-মেয়েসহ সবাই ঘুরতে এসেছি এই মেলায়। খুব ভালো লাগছে মেলা ঘুরে। তাদের মধ্যে প্রবীণ একজন বলেন, আমার বয়স ৯৬ বছর চলে, আমি সর্বশেষ ৭০ বছর আগে পোড়াদহ মেলায় এসেছিলাম। আগে এই পোড়াদহ মেলা এই স্থানেই হতো আরও বড় পরিসরে। এখন এই মেলাটি পুরো বগুড়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এখানে আসার আগে আমি আরও দুটি মেলা ঘুরে এখানে এসেছি। প্রায় ১৫ থেকে ২০ গ্রাম নিয়ে এ মেলা হতো। এখানে ঘোড়া দৌড়সহ বিভিন্ন গ্রামীণ সংস্কৃতির অনুষ্ঠান হতো। এখন জমিতে চাষাবাদ ও জায়গা সংকটের কারণে মেলাটি বিভিন্ন জায়গায় হচ্ছে। আমরা মাছ কিনেছি, এখন মিষ্টি কেনার জন্য যাচ্ছি।
মিষ্টি বিক্রেতা শমসের ঘোষ বলেন, আমরা প্রায় ১০ দিন আগে থেকে মিষ্টি তৈরি করছি। দীর্ঘ সাত বছর যাবৎ আমি মেলায় মিষ্টির দোকান করি। মিষ্টি চাহিদা এত বেশি থাকে যে আমরা এখানে মিষ্টি তৈরি করেও ক্রেতাদের জোগান দিতে পারি না। আশা করছি এবার প্রায় ৮ থেকে ১০ লাখ টাকার মিষ্টি বিক্রি হবে। অনেক রকম মিষ্টি থাকলেও মাছ আকৃতির মিষ্টি চাহিদা বেশি এই মেলায়।
মেলায় আসা ফরিদউদ্দিন বলেন, মেয়ে-জামাইসহ আত্মীয়-স্বজনরা বাসায় এসেছেন। সকালে মাছ কিনেছি এখন মিষ্টি নিতে এসেছি। ভাবছি একটি বড় আকৃতির মাঝে মিষ্টি নেব এবং পাঁচ কেজি গোল মিষ্টি নেব। শুধু আমি না আশপাশে দু-চার গ্রামের মানুষ মেলা উপলক্ষে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় নিমন্ত্রণ করেছে।
গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই মেয়ে-জামাই এসেছেন। মেলার বেশির ভাগ মাছই কেনেন জামাইরা। তা ছাড়া বড় বড় মাছ দেখে-শুনে কিনতে মেলায় আগমন ঘটে নারীদেরও। মেলার খ্যাতি ছড়িয়ে আছে জেলার বাইরেও, তাই দূরদূরান্ত থেকে মেলায় আসেন অনেকেই। তাদের খাবারের প্রয়োজনে মেলার ভেতরে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় অসংখ্য হোটেল। উত্তরের জেলাগুলোতে বেশ সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে পোড়াদহ মেলার। এই মেলাটি মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসব হলেও এখন সর্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। জেলাজুড়ে বইছে উৎসবের আমেজ।
আয়োজক কমিটির সভাপতি আব্দুল মজিদ মন্ডল বলেন, মেলাটি বংশানুক্রমে সর্বশেষ আমার বাবা দেখভাল করতেন, এখন আমি করছি। এই মেলা মূলত একটি মাছের মেলা। এ ছাড়া কাঠের তৈরি আসবাবপত্র, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ চুন-পান সবই পাওয়া যায়। তিনি আরও বলেন, এই মেলায় প্রায় ৪০০০টির ওপরে দোকান রয়েছে।
গাবতলী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশিক ইকবাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঐতিহাসিক পোড়াদহ মেলাকে কেন্দ্র করে আমরা তিনস্তরের নিরাপত্তা গ্রহণ করেছি। পুলিশ সাদা পোশাকে পুলিশসহ গোয়েন্দা বিভাগের সদস্যরা গতকাল থেকে মেলায় নিয়োজিত রয়েছেন। মেলা শেষ হওয়া পর্যন্ত এই নিরাপত্তা জোরদার থাকবে।
এএমকে