লেখাপড়া শেষ করার পর আর বেকার বসে থাকতে হচ্ছে না। এমনকি পার্টটাইম চাকরি করেও প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ারও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞানে সমৃদ্ধ তরুণ-তরুণীদের এখন নিজ শহরেই হচ্ছে কর্মসংস্থান। দেশের প্রথম ডিজিটাল জেলা যশোরে কর্মসংস্থানের এমন দুয়ার খুলে দিয়েছে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক। উদ্বোধনের তিন বছরের মধ্যেই পার্কটিতে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে দুই হাজারেরও বেশি তরুণ-তরুণীর। 

শিল্পায়নে পিছিয়ে থাকা যশোর কর্মসংস্থানের দিক থেকে পিছিয়ে পড়েছিল দীর্ঘদিন। তাই সেরকম ক্ষেত্র না থাকায় জেলায় চাকরির বাজারও ছিল মন্দা। আইটি বা তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের পর এ জেলার তরুণদের চাকরির জন্য ছুটতে হতো বড় শহরে। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া তাদের অন্য কোথায় চাকরি মিলত না। কিন্তু এখন দিন বদলেছে। আর এই দিন বদলের সূচনা করেছে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক। ফলে প্রযুক্তিশিল্পের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে যশোরবাসী। তরুণরা স্বপ্ন দেখছেন যশোরে থেকেই সম্ভাবনাময় এক ক্যারিয়ার গড়ার।

জানা গেছে, ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক উদ্বোধন করা হয়। যশোর শহরের নাজির শঙ্করপুর এলাকায় ১২ একরেরও কিছু বেশি জমিতে পার্কটি করতে সরকারের ব্যয় হয়েছে ৩১০ কোটি টাকা। তথ্যপ্রযুক্তির এই বাণিজ্যিক কেন্দ্রটি হয়ে এখানকার আশার বাতিঘর উঠেছে। 

তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য উদ্ভাবন ও বাজারজাতকরণের মাধ্যমে বেশ আয় করছে এখানকার আইটি প্রতিষ্ঠানগুলো। আর এসব প্রতিষ্ঠানে ফুলটাইম ও পার্টটাইম চাকরির সুযোগে সৃষ্টি হয়েছে। তবে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না হওয়ায় একটা পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে অগ্রগতি থমকে যাচ্ছে। পার্কটিতে তথ্যপ্রযুক্তি পণ্যের এক বিরাট বাজার গড়ে তোলার যেরকম সম্ভাবনা ছিল ঠিক ততটা হয়নি।

শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক

পার্কটি চালুর সময় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন- যশোর শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক হবে বাংলাদেশের সিলিকন ভ্যালি। এখানে ২০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। 

কিন্তু দক্ষ জনবলের অভাব, ইজারামূল্য নিয়ে বিরোধ, উচ্চ গতির ইন্টারনেট ও বিদ্যুৎসেবা না থাকায় ব্যবসার পরিধি বাড়েনি। আর তাই মাত্র তিন বছরের মাথায় পার্ক ছেড়েছে ২০টি প্রতিষ্ঠান।

আলাপচারতিায় এখানকার বিনিয়োগকারীরা বলেন, সরকার যেসব স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ দেয়, তাতে কোনো দক্ষ কর্মী তৈরি হয় না। ফলে বেশিরভাগ স্পেস (জায়গা) এখনো খালি রয়েছে। আশানুরূপ বিনিয়োগ না হওয়ায় কর্মসংস্থান কম তৈরি হয়েছে। তারপরও এটিকে ঘিরেই নতুন দিনের সম্ভাবনাও আছে। 

পার্কটির অ্যাবাকাস সফট বিডি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহির ইকবাল নান্নু বলেন, পিছিয়ে পড়া দেশের প্রথম ডিজিটাল জেলা এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখছে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক। বৃহত্তর যশোর অঞ্চলের কর্মসংস্থানের দুয়ার খুলেছে এটি। 

তিনি বলেন, এই পার্কে দুই শ্রেণির উদ্যোক্তা রয়েছে। যারা প্রকৃতপক্ষে তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে জানেন ও বোঝেন। আর এখানে আরেক দল আছে যারা এটি সর্ম্পকে কিছুই বোঝেন না। যারা প্রকৃত অর্থে এটি সম্পর্কে ভালো জানেন ও বোঝেন তারা কিন্তু ভালো করছেন।

পার্কটির অ্যাবাকাস সফট বিডি লিমিটেডে কর্মরত বায়জিদ মাহমুদ অভি বলেন, আমাদের কোম্পানিতে বিভিন্ন সফটওয়্যারসহ আইটি সেক্টরের সকল কাজ হয়ে থাকে। পাশাপাশি এখানে আইটি সম্পর্কিত বিভিন্ন ট্রেনিং সেন্টারও রয়েছে। যার মাধ্যমে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী আইটিতে দক্ষ হয়ে উঠছেন। আমি বিভিন্ন জায়গায় চাকরি না খুঁজে এখানে কাজ করছি। এই ধরণের কাজগুলো সাধারণত যশোরের মতো জায়গায় হতো না। সরকারের সুদৃষ্টির কারণে যশোরে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক নির্মাণ হয়েছে। ফলে আমার মতো হাজারো তরুণ-তরুণীর এখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।

শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে কাজ করছেন তরুণ-তরুণীরা

 আইটি পার্কে কর্মরত নাজমুল সাকিব নামে এক তরুণ বলেন, আমরা এখানে বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটের সঙ্গে বিভিন্ন আইটি সম্পর্কিত কাজগুলোই করে থাকি। যশোরে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের মতো প্রতিষ্ঠান চালু হওয়ায় আমার মতো তরুণ শিক্ষার্থী বা যাদের লেখাপড়া শেষ হয়ে গেছে তাদের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। আমি মনে করি এটি একটি পজিটিভ দিক। এই পার্কের মাধ্যমে আমাদের নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে পারছি। সেই সঙ্গে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে নিজেরা আত্মনির্ভশীল হতে পারছি।
 
পার্কটির ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মহিদুল ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কে তুলনামূলক ভাড়া বেশি। এছাড়াও আমরা সর্বোচ্চ রেটে বিদ্যুৎ বিল দিয়ে থাকি। এই বিদ্যুৎ বিল কমানোর বা বিলটা বিশেষ শিল্পজোনের আওতায় আনার জন্য পার্ক কর্তৃপক্ষকে বার বার জানানো হয়েছে। তারা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন বলে আমাদের জানিয়েছেন। 

পার্কে যারা উদ্যোক্তা রয়েছেন দিন দিন তাদের কর্মকাণ্ড সম্প্রসারিত হচ্ছে। যারা আরও বৃদ্ধি করত চায় সরকার যদি তাদের বিভিন্ন বিনিয়োগের ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে সরকার যে লক্ষে পার্কটি নির্মাণ করেছে সেটি দ্রুত বাস্তবায়িত হবে। পার্কে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য কর্তৃপক্ষ যদি পণ্যগুলো প্রমোশন করার ব্যবস্থা করে তাহলে নতুন নতুন বিনিয়োগ পাওয়া সহজ হয়ে যাবে। 

শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান টেক সিটি। টেক সিটির ব্যবস্থাপক মেজর (অব.) এম ইউ সিকদার ঢাকা পোস্টকে জানান, সারাদেশের ৩৯টি হাইটেক পার্কের মধ্যে শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কটি রোল মডেল ও পথ প্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে। এখানকার উদ্যোক্তারা যাতে সফল হতে পারেন তার জন্য সরকার তাদের অনেক সুবিধা দিচ্ছে। তাদের ১৫ বছরের জন্য ট্যাক্স ফ্রি করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিশ্বমানের যেসব সুযোগ-সুবিধা আছে সেগুলোও ভর্তুকি মূল্যে দিচ্ছে। পাশাপাশি করোনার কারণে আইটি বিজনেসেও ধাক্কা লাগায় উদ্যোক্তাদের আট মাসের ভাড়া মওকুফ করেছে সরকার।

যশোরেই হচ্ছে প্রযুক্তিতে দক্ষ তরুণ-তরুণীদের কর্মসংস্থান

তিনি আরও জানান, এখানে বর্তমানে দেড় কোটি টাকা বিদ্যুৎ বিলও বকেয়া রয়েছে। ভাড়া মওকুফের ফলে ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা পার্কটি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা টেক সিটিকে বহন করতে হচ্ছে। এতে টেক সিটিকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। 

মেজর (অব.) এম ইউ সিকদার বলেন, তিন বছরে টেক সিটি ব্যাপক ক্ষতির মুখে থাকলেও আমরা আশাবাদী এক সময়ে এই পার্কে আরও উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করবেন এবং পার্কটির পরিবেশ আরও ভালো হবে। এখানকার উদ্যোক্তাদের ব্যবসা ভালো হওয়ার সঙ্গে মুনাফাও পাবে। সেই সঙ্গে পার্কটির ব্যবস্থাপনাকারী টেক সিটিও ভালো মুনাফা অর্জন করতে পারবে। 

টেক সিটি জানিয়েছে, শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কের মূল ভবন ভূমিকম্প প্রতিরোধক কম্পোজিট কাঠামোতে (স্টিল ও কংক্রিট) নির্মিত হয়েছে। পার্কটির মূল ১৫ তলা ভবনে আড়াই লাখ বর্গফুট জায়গা ইজারাযোগ্য। এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রায় ৯৫ হাজার বর্গফুট জায়গা ইজারা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে এই পার্কটিতে ৫৫টি আইটি ও আইটিএস বিজনেস প্রতিষ্ঠান জায়গা বরাদ্দ নিয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে প্রায় ৪৫টি কোম্পানি কাজ করছে।  এছাড়া ৯৮ হাজার বর্গফুটের ১২তলা আবাসিক ভবন (ডরমিটরি), ২৫ হাজার বর্গফুটের বেজমেন্ট ফ্লোরসহ তিনতলা মাল্টিপারপাস ভবন রয়েছে এখানে। 

পার্কটিতে ফাইবার অপটিক কানেক্টিভিটি রয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সাপ্লাইয়ের জন্য ১১ হাজার কেভিএম বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন এবং দুই হাজার কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জেনারেটর  স্থাপন করা হচ্ছে। পার্কের মূল ভবনের সামনে পাঁচ একরের একটি বিশাল জলাধারও রয়েছে।

আরএআর