মাছে ভাতে বাঙালি। মাছপ্রেমি বাঙালির পাতে ভাতের অভাব না হলেও, অভাব রয়েছে মাছের। বিশেষ করে দেশি মাছগুলো বিলুপ্তির পথে। নদীতে দূষণ আর পলি পড়ায় মাছের উৎপাদন আর আগের মতো নেই। তাই সচরাচর দেখা মিলে না দেশি মাছের। বাজারে আকাশছোঁয়া দামে বিক্রি হয় যে মাছ, তা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অনেকটাই বাইরে। ২০১৫ সালে আইইউসিএন’র তথ্য মতে, বাংলাদেশে স্বাদুপানির ২৬০টি মাছের মধ্যে ৬৪টি প্রজাতি বিলুপ্তপ্রায়। 

তবে আশার কথা হলো, দিনদিন এ অবস্থার পরিবর্তন এনেছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)। একে একে ২৫টি বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় প্রজাতির মাছের কৃত্রিম প্রজননে পোনা উৎপাদন ও চাষাবাদ কৌশল উদ্ভাবনে সফল হয়েছেন বিএফআরআইয়ের গবেষকরা। সর্বশেষ এ তালিকায় সংযোজন হল দেশীয় বাতাসি মাছ। 

বগুড়ার সান্তাহারে অবস্থিত ইনস্টিটিউটের ‘প্লাবনভূমি উপকেন্দ্রে’ এ সফলতা পায়। ফলে মাঠ পর্যায়ের চাষিরা ব্যাপকভাবে এ বাতাসি মাছ চাষে আগ্রহী হবেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা। 

জানা গেছে, বাতাসি মাছের বৈজ্ঞানিক নাম Notropis Atherinoides। এ প্রজাতির মাছ সাধারণত বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল এবং মায়ানমারে বেশি দেখা যায়। বর্তমানে ব্রহ্মপুত্র নদসহ কয়েকটি নদীতে সুস্বাদু বাতাসি মাছ জেলেদের জালে ধরা পড়লেও হাটবাজারে খুব কমই পাওয়া যায়। বাজারে দেখা গেলেও এর দাম প্রতিকেজি ৬০০ টাকা থেকে ৮০০ টাকায় বেচাকেনা হয়। 

বাতাসি মাছের গবেষকদলের প্রধান ড. ডেভিড রিন্টু দাস বলেন, বাতাসি মাছ একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ মাছ। প্রতি ১০০ গ্রাম খাবার উপযোগী বাতাসি মাছে পটাশিয়াম ৬১০ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ৪০০ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ২০০ মিলিগ্রাম, জিঙ্ক ১৪.৪ মিলিগ্রাম, আয়রন ৩৩.০ মিলিগ্রাম এবং ম্যাঙ্গানিজ ২০০ মিলি গ্রাম রয়েছে। যা অন্যান্য দেশীয় ছোট মাছের তুলনায় অনেক বেশি। জিঙ্ক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. ডেভিড রিন্টু দাস ছাড়াও গবেষক দলে আরও ছিলেন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান ও মালিহা খানম। 

গবেষকরা জানান, বগুড়ার সান্তাহার প্লাবনভূমি উপকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা কয়েক বছর ধরে খরস্রোতা যমুনা ও আত্রাই নদীসহ বিভিন্ন উৎস থেকে বাতাসি মাছের পোনা সংগ্রহ করে উপকেন্দ্রের পুকুরে নিবিড়ভাবে প্রতিপালন করেন। এসময় বাতাসি মাছের খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস পর্যবেক্ষণ করে খাদ্যাভ্যাস অনুযায়ী খাবার সরবরাহ করা হয়। 

গবেষণায় দেখা গেছে, একটি পরিপক্ক বাতাসি মাছের খাদ্য নালিতে শতকরা ৮৬ ভাগ প্লাংটন ও ১৪ ভাগ অন্যান্য খাদ্য বস্তুর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া বছরব্যাপী জিএসআই ও হিস্টোলজি পরীক্ষণের মাধ্যমে বাতাসি মাছের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম নির্ধারণ করা হয়। 

গবেষণায় আরো দেখা গেছে, এ মাছটির দৈর্ঘ্য সর্বোচ্চ ১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এর দেহ চ্যাপ্টা এবং উপরের চোয়াল নীচের চোয়ালের চেয়ে কিছুটা লম্বা। বাতাসি মাছের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম হচ্ছে মে থেকে জুলাই। ডিম ধারণক্ষমতা আকার ভেদে ১২০০-২৫০০টি। একটি পরিপক্ক স্ত্রী বাতাসি মাছ চার দশমিক শূন্য গ্রাম থেকে ছয় দশমিক শূন্য গ্রাম ওজনের হলেই প্রজনন উপযোগী হয়। প্রজনন উপযোগী পুরুষ বাতাসি মাছ স্ত্রী বাতাসি মাছের চেয়ে আকারে অপেক্ষাকৃত ছোট (২.৫-৪.০ গ্রাম) হয়। 

বিএফআরআইয়ের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, প্রজনন মৌসুমে শুরু হলে চলতি মে মাসে বাতাসি মাছকে হরমোন ইনজেকশন দেয়া হয়। হরমোন প্রয়োগের ১২-১৫ ঘণ্টা পর মাছটি ডিম ছাড়ে এবং ২৩-২৫ ঘণ্টা পর নিষিক্ত ডিম থেকে রেণু পোনা উৎপাদিত হয়। ডিম নিষিক্ততার হার ছিল শতকরা প্রায় ৭৩ ভাগ। উৎপাদিত রেণু বর্তমানে প্লাবনভূমি উপকেন্দ্রের হ্যাচারিতে প্রতিপালন করা হচ্ছে।

ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ আরও বলেন, দেশীয় মাছ সংরক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে বিএফআরআই ময়মনসিংহের স্বাদুপানি কেন্দ্রে ২০২০ সালে একটি ‘লাইভ জিন ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এরফলে বিলুপ্তপ্রায় মাছ পুনরুদ্ধার করার লক্ষে ইনস্টিটিউটের গবেষণা কার্যক্রম আরো জোরদার করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব বিলুপ্তপ্রায় মাছের প্রজনন ও পোনা উৎপাদন-কৌশল উদ্ভাবনের মাধ্যমে চাষিরা আবার এসব মাছ চাষ করবেন এবং বাজারে ফের মিলবে বিলুপ্তপ্রায় এসব দেশী মাছ। 

বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায় পিয়ালী, কাজলি, কাকিলা, রানি ও গাঙ টেংরাসহ আরও আটটি মাছ নিয়ে গবেষণা চলছে বলেও জানান ইন্সটিটিউটটির মহাপরিচালক। 

এমএএস