কাঁসা শিল্পের কারখানাগুলো নানা সংকটে পড়ে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে

নেই পর্যাপ্ত মূলধন, সৃষ্টি হচ্ছে না নতুন কারিগর, শ্রমের মূল্যবৃদ্ধি ও কাঁচামালের সঙ্গে পণ্যের ক্রয়-বিক্রয়ের দামের অসঙ্গতি ইত্যাদি কারণে অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়েছে ঐতিহ্যবাহী কাঁসা শিল্প। জামালপুর জেলার ইসলামপুর উপজেলার দরিয়াবাদ গ্রামে ঐতিহ্যবাহী কাঁসা শিল্পের কারখানাগুলো নানা সংকটে পড়ে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে।

বাঙালির ঐতিহ্যের সঙ্গে কাঁসা শিল্পের সম্পর্ক আদি। ইসলামপুরের কাঁসা শিল্পের ইতিহাস কয়েকশ বছরের। এর খ্যাতি ও নাম বিশ্বজুড়ে। নানা বিকল্পের যুগে এসেও এ শিল্পের চাহিদা ও মান অক্ষুণ্ণ। এ এলাকার কারিগরদের তৈরি থালা বাটি, চামচ ও ডিনারসেট ইত্যাদির সুখ্যাতি রয়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শিল্পী বা কারিগরদের ভাগ্যের উন্নয়ন হয়নি। তাদের জীবনধারা ও মানে নেই কোনো পরিবর্তন। এ শিল্পের মালিক-শ্রমিক একই সূত্রে গাঁথা। শুধু বেঁচে থাকার তাগিদেই জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাপ-দাদার পেশাকে ধরে রেখেছে তারা।

এই এলাকার কাঁসা শিল্প কারখানাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণ কারিগর অনিল কর্মকার (৭০)। তিনি জানান, ১৬ বছর বয়সে তিনি বাপ-দাদার পেশায় যুক্ত হন। তার সঙ্গে দুই ভাই স্বর্গীয় যতীন্দ্র কর্মকার ও সুনিল কর্মকারের পেশাও ছিল কাঁসা শিল্পের পণ্য প্রস্তুত ও বিক্রি। সেই সময়ে এই পেশার যে খ্যাতি ও যশ ছিল তা আজ আর নেই। নানা কারণে তা হারিয়ে গেছে।

তিনি বলেন, ২০-৩০ বছর আগেও দরিয়াবাদে ১৫-২০টি কাঁসা শিল্পের কারখানা ছিল। কমতে কমতে আজ এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭-৮টিতে। তখন এক কেজি ভাঙা কাঁসার দাম ছিল চারশ টাকা, এখন সেটি দাম দাঁড়িয়েছে ১২শ টাকায়। এখন প্রতিকেজি কাঁসার পণ্য বিক্রি হয় ২ হাজার থেকে ২২শ টাকায়। বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি কারখানায় বড়জোর ৬ কেজি পণ্য প্রস্তুত করা যায়। একদিনে একটি কারখানায় শ্রমিক খাটে পাঁচ থেকে ছয় জন। প্রতিজনের বেতন পাঁচ থেকে সাতশ টাকা। কাঁচামাল ও শ্রমিকের মজুরি দেওয়ার পর কারখানা মালিকের শুধু নিজের মজুরিটাই থাকে, আর কিছু না।

অনিল কর্মকার জানান, তাদের তৈরি আসবাবপত্রের চাহিদা এখনও ব্যাপক। কিন্তু পর্যাপ্ত মূলধন না থাকায় চাহিদা অনুপাতে সরবরাহ করতে পারছেন না তারা। সরকার যদি তাদের এ শিল্প কারখানাগুলোর নামে সহজ শর্তে শিল্প ঋণ দেয় তাহলে হয়ত এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পটি আরও কয়েক শতাব্দী মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারত।

কাঁসা শিল্পের আরেক কারিগর বিরেন চন্দ্র কর্মকার বলেন, আমাদের এ কাঁসা শিল্পের খ্যাতি জগৎ জুড়ে। সৌন্দর্য ও মানের দিক থেকে আমাদের পণ্যের বিকল্প নেই। কিন্তু আমাদের এ ঐতিহ্যবাহী পেশাটি হয়ত আর বেশিদিন টিকিয়ে রাখা যাবে না। শ্রমের মূল্যবৃদ্ধি, নতুন কারিগর তৈরি না হওয়া ও কাঁচামাল এবং পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ে দামের অসঙ্গতি ইত্যাদির কারণে আমরা অস্তিত্ব সংকটে পড়েছি।

তিনি বলেন, এক কেজি বাসন তৈরি করতে যে পরিমাণ পুঁজি ও শ্রম লাগে সেই তুলনায় মুনাফা আসে না। শ্রমের তুলনায় অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারণে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এই পেশায় যুক্ত হচ্ছে না। তারা বাপ-দাদার ঐতিহ্য ধরে রাখতে আগ্রহ প্রকাশ করছে না, বিকল্প পেশা খুঁজছে। আমি নিশ্চিত, আমার মৃত্যুর মাধ্যমে আমাদের এ পারিবারিক ধারার বিলুপ্তি ঘটবে।

দরিয়াবাদ কাঁসা শিল্প কারখানার বিখ্যাত কারিগর উত্তম কর্মকার। তার কাজের সূক্ষ্মতা ও নিপুণতার প্রশংসা ব্যাপক। সেই উত্তম কর্মকার বললেন ভিন্ন কথা। তিনি সিস্টেম ও নিজেদের প্রতিনিধির প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা অনেক হয়েছে। আর বলতে চাই না। বলে কোনো লাভ হয় না। লাভ যদি কারও হয় তা হয় আমাদের দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের। যারা আমাদের সমস্যা-সম্ভাবনাকে পুঁজি করে, আমাদের ব্যবহার করে বরাবরই লাভবান হয়। তারাই আমাদের মাঝে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে আমাদের কোণঠাসা করে রেখেছে। তাদের অসৎ উদ্দেশ্যের কারণেই আমাদের এ শিল্পটি আজ বিলুপ্তির পথে। দুর্যোগ, মহামারি ও নানা সংকটেও সমাজ বা রাষ্ট্রের কাছ থেকে আমরা কোনো প্রণোদনা পাইনি। সামনে আমরা ঘোর অন্ধকার দেখছি। টিকে থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই।

ইসলামপুরের ঐতিহ্যবাহী কাঁসা শিল্পের মান উন্নয়ন ও অগ্রগতীর ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসন কী ব্যবস্থা নিয়েছে? এমন প্রশ্নের দায়সারা উত্তর দিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস.এম. মাজহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, এ শিল্পের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে কাঁসা পণ্য ডট কম নামে একটি ওয়েব সাইট খোলার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু নানা ব্যস্ততার কারণে তা হয়ে উঠেনি। গেল ঈদে এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত ৬০টি পরিবারকে খাদ্য উপকরণ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

এসএসএইচ