আইইডিসিআরের অনুসন্ধান
বরগুনায় বেড়েছে ডেঙ্গু, রান্নার জন্য জমানো পানিই কি কারণ?
বরগুনায় বেড়েই চলেছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন দুই হাজার ৪৯৫ জন। যা সারা দেশের মোট আক্রান্তের প্রায় ৩২ শতাংশ। ডেঙ্গু সংক্রমণের এমন পরিস্থিতির পেছনে ‘বাসাবাড়িতে রান্নার জন্য জমিয়ে রাখা বৃষ্টির পানি’ প্রধান কারণ বলে জানিয়েছেন অনুসন্ধানে আসা রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সদস্যরা।
বরগুনা সিভিল সার্জন অফিসের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বরগুনা জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৬৮ জন। বর্তমানে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে মোট ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন ২৩৪ জন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত বরগুনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে সাতজন ডেঙ্গু রোগীর।
বিজ্ঞাপন
গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বরগুনা জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৬৮ জন। বর্তমানে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে মোট ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন ২৩৪ জন। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত বরগুনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে সাতজন ডেঙ্গু রোগীর
বরগুনা সদর উপজেলার ২ নম্বর গৌরীচন্না ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে জানা যায়, ইউনিয়নের মনসাতলী ও লাকুরতলা এলাকা দুটি পৌরসভা সংলগ্ন হওয়ায় মানুষের বসবাস বেড়েছে। এখানকার বাসিন্দাদের পানির প্রধান উৎস সাপ্লাই ও টিউবওয়েল। তবে, পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অচল হয়ে আছে বেশিরভাগ টিউবওয়েল। তাই প্রায় সব কাজে সাপ্লাই করা পানি ব্যবহার করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
আরও পড়ুন
বিজ্ঞাপন
অন্যদিকে, এলাকায় কোনো পুকুর না থাকায় বিশেষত রান্নার জন্য অধিকাংশ বাসিন্দা বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখেন। এই ইউনিয়নে প্রয়োজনীয় ড্রেনেজ ব্যবস্থাও নেই। যে কারণে দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত পানি ও বৃষ্টির পানি বাসাবাড়ির আশপাশে বিভিন্ন ডোবা, নালা ও নিচু জমিতে জমে থাকে। আর এসব জমে থাকা পানি হয়ে উঠেছে এডিস মশার আবাসস্থল।
মনসাতলী এলাকার বাসিন্দা সুলতানা পারভীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এলাকায় কোনো পুকুর নেই। রান্নার জন্য দূরে থেকে নদীর পানি সংগ্রহ করতে হয়। সাপ্লাইয়ের পানিতে রান্না করলে খাবার লালচে হয়ে যায়। কাছাকাছি নদীও নেই। অনেকে টাকার বিনিময়ে নদীর পানি সংগ্রহ করেন। টাকা খরচ করে পানি আনতে হয় বলে বৃষ্টি হলে পানি সংগ্রহ করে তা ড্রামে ভরে রাখেন অনেক বাসিন্দা।
ওই এলাকার আরেক বাসিন্দা সোহরাব হোসেন বলেন, শহরের খুব কাছে হওয়ায় আমাদের এলাকায় মানুষের বসবাস বেড়েছে। তবে, ইউনিয়ন হওয়ায় এখানে কোনো পরিচ্ছন্নতা কর্মী নেই। বৃষ্টি হলেই ডোবা-নালায় পানি জমে থাকে।
শারমিন নামে আরেক বাসিন্দা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভালো রান্নার জন্য ভালো পানি প্রয়োজন। বৃষ্টির পানি পরিষ্কার থাকায় আমরা তা সংগ্রহ করে রাখি। তবে, অনেকেই পানির ড্রাম খোলা রাখেন। আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে, বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করলেও তা নিরাপদভাবে রাখতে হবে।
এদিকে, হঠাৎ ব্যাপক হারে বরগুনায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে সরেজমিনে পরিদর্শনে আসেন আইইডিসিআরের ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। গত চার-পাঁচদিন ধরে তারা বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগী ও আক্রান্তদের এলাকা পরিদর্শন করে তথ্য সংগ্রহ করেন।
আইইডিসিআরের ওই প্রতিনিধি দল বলছে, বরগুনায় ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ, এলাকার বাসিন্দারা অপরিকল্পিতভাবে বৃষ্টির পানি ড্রামসহ বিভিন্ন পাত্রে দীর্ঘদিন জমিয়ে রাখেন। ওই পানিতে এডিস মশার লার্ভা জন্ম নিচ্ছে বলে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছেন তারা।
আইইডিসিআরের অনুসন্ধানকারী প্রতিনিধি দলের নেতা এফইটিপিবি ফেলো (অ্যাডভান্সড-১০ম কোহোর্ট) ডা. মো. তারিকুল ইসলাম লিমন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুই-তিনদিন ধরে আমরা বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়ি ঘুরে দেখেছি, রান্না ও খাওয়ার জন্য অনেকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করেন। এই জমা পানি এডিস মশা জন্মাতে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। যারা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করেছেন, তাদের বাড়িতে থাকা কোনো না কোনো পাত্রে আমরা এডিসের লার্ভা পেয়েছি। তবে, অনেকেই পানিতে থাকা এডিসের লার্ভাকে পানির পোকা মনে করে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। এছাড়া নিয়মিত পানির পাত্র পরিষ্কার না করেই দীর্ঘদিন পানি জমিয়ে রাখছেন। এ কারণে বরগুনায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে বলে আমরা মনে করছি।
বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. রেজওয়ানুর আলম বলেন, জেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করেন। যে বাসায় পানি জমা রাখা হচ্ছে, ওই বাসায় এডিসের লার্ভা তৈরি হচ্ছে এবং তারাই মূলত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি। এ কারণে একই পরিবারের অনেকে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
এ বিষয়ে বরগুনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনুসন্ধানে আসা আইইডিসিআরের সদস্যরা পর্যবেক্ষণ করে জানিয়েছেন যে, বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়িতে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণে যেসব ড্রাম রয়েছে সেখানেই সবচেয়ে বেশি এডিস মশার লার্ভা রয়েছে। প্রাথমিক অবস্থায় জেলা প্রশাসন ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা বাসাবাড়িতে গিয়ে মানুষকে সচেতন করছেন। পরে যদি কেউ নিরাপদ উপায়ে পানি সংরক্ষণ না করেন, তাহলে আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।
ডেঙ্গুর সর্বশেষ পরিস্থিতি
শনিবার (২৮ জুন) সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরও ২৬২ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১৪১ জন আক্রান্ত হয়েছেন বরিশাল বিভাগে। এ সময় ডেঙ্গুতে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে।
শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত সবমিলিয়ে ৯ হাজার ৪৮৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আর চলতি বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের।
মো. আব্দুল আলীম/এসএসএইচ