সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার ধুকুরিয়াবেড়া ইউনিয়নের ব্রাহ্মণ গ্রামে এক ব্যতিক্রমী বিয়ের আয়োজন করেছে এলাকাবাসী ও মানবতার ফেরিওয়ালা খ্যাত মামুন বিশ্বাস। মা-বাবাহীন অসহায় মোছা. উর্মী খাতুন (১৮)-এর বিয়ে মঙ্গলবার (১৩ জুলাই) বিকেলে একই গ্রামের আব্দুল কাইয়ুমের ছেলে মো. জামিল খান (২২)-এর সঙ্গে সম্পন্ন হয় রাজকীয় আয়োজনে।

উর্মী খাতুনের বাবা-মা প্রায় ১০ বছর আগে ডিভোর্স করে আলাদা হয়ে যান। উভয়েই পুনরায় বিবাহ করে চলে যান নিজেদের জীবনে। সেই থেকে উর্মীর আশ্রয় হয় তার বৃদ্ধ নানা-নানির কাছে। সংসারে আয়ের কেউ না থাকায় মেয়েটির বিয়ের আয়োজন করা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে। এরপর সমাজের সহানুভূতিশীল মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকেন তার নানা-নানি।

স্থানীয়ভাবে বিয়ে ঠিক হলেও অর্থের অভাবে তা ভেঙে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। এ অবস্থায় উর্মীর এক আত্মীয় দিপু ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন। সেই পোস্ট দেখে মানবতার ফেরিওয়ালা হিসেবে পরিচিত মামুন বিশ্বাস এগিয়ে আসেন। তিনি উর্মীর নানির সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন এবং একটি পোস্ট করেন নিজের ফেসবুকে।

পোস্টটি ভাইরাল হলে দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ সাড়া দেন। মোট এক লাখ ৭ হাজার টাকা সংগ্রহ হয় বিয়ের জন্য। এ অর্থ দিয়ে আয়োজন করা হয় একটি পূর্ণাঙ্গ ও সম্মানজনক বিয়ে। উর্মী খাতুনকে জাঁকজমকভাবে সাজানোর জন্য পার্লার থেকে মেকআপ আর্টিস্ট আনা হয়। কেনা হয় বিয়ের শাড়ি, হলুদের কাপড়, জুতা, কসমেটিকসসহ প্রয়োজনীয় সকল জিনিসপত্র। দেওয়া হয় একটি সকেজ, আলমারি, ল্যাম্প, কম্বলসহ একটি নতুন সংসার শুরু করার যাবতীয় জিনিস।

বিয়েতে অতিথিদের জন্য রান্না করা হয় সবজি, মুরগির রোস্ট, গরুর মাংস ও দই। শতাধিক মানুষকে আপ্যায়ন করা হয় উৎসবমুখর পরিবেশে। এলাকাবাসীর অংশগ্রহণে ব্রাহ্মণ গ্রাম যেন এক আনন্দঘন মিলনমেলায় পরিণত হয়।

বিয়ের দিন মঙ্গলবাল বরবেশে উপস্থিত হন জামিল খান। বিয়ের গেটে জামাইকে করা হয় আপ্পায়ন। এরপর নতুন জামাইকে ঘড়ি পরিয়ে বরণ করেন উর্মীর নানা। অন্যদিকে, পাত্রী উর্মী খাতুনকে পরিবেষ্টিত করে রাখে প্রতিবেশীরা। উল্লাস ও নানা আয়োজন পুরো বিয়ে ঘিরে এক রাজকীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

উর্মী খাতুনের মামা মো. আনিসুর রহমান বলেন, উর্মীর বাবা-মায়ের ১০ বছর আগেই ডিভোর্স হয়ে যায়। তার নানা-নানি ব্যতীত দেখার কেউ ছিল না। উর্মীর নানা অসহায় ও গরিব হওয়ায় বিবাহ দেওয়ার সুযোগ ছিল না। পরে নানা ও নানি এলাকাবাসীর সহায়তা চান। এজন্য আমার চাচাতো ভাই দিপু ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন। সেই পোস্ট দেখেন মামুন বিশ্বাস। তারপর তিনি এগিয়ে আসেন এই অসহায় পরিবারের সাহায্য করার জন্য। সবমিলিয়ে একটি রাজকীয় বিয়ের আয়োজন ছিল, কোনো অপূর্ণতা ছিল না।

গ্রামের চান মিয়া বলেন, একটা অসহায় এতিম পরিবারের ভেতরে বিবাহবন্ধন করে তাদের পরিবার সচ্ছল করার জন্য এতো বড় একটা উদ্যোগ ও অনুষ্ঠান জীবনে খুব কম দেখেছি। আমরা গ্রামবাসীও মামুন বিশ্বাসের সাথে সহযোগিতা করেছি। কয়েক বছর যাবৎ উনারা বিভিন্ন রকম উদ্যোগ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তারা যেন ভবিষ্যতে এ রকম আরও ভালো কাজ করে যেতে পারেন ও তাদের সফলতা কামনা করছি।

বিয়েতে কনে উর্মী খাতুন বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই নানা নানির কাছে বড় হয়েছি। আমি কোনোদিন চিন্তাও করি নাই এতো বড় আয়োজনে আমার বিয়ে হবে। যারা বিয়ের জন্য কষ্ট করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।

বর মো. জামিল খান বলেন, অসহায় উর্মীকে বিয়ে করতে পেরে আমি খুবই গর্বিত। দাম্পত্য জীবনে সকলের নিকট দোয়া প্রত্যাশা করছি।

গ্রামের বৃদ্ধ মো. আব্দুল মালেক বলেন, উর্মীর বয়স হওয়ায় বিয়ের জন্য আর্থিক সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল। পরে মামুন বিশ্বাসকে জানালে তিনি বিয়ের আয়োজন করেন। আজকে রাজকীয় আয়োজনে বিয়ের হওয়ায় আমরা খুব খুশি।

স্বেচ্ছাসেবক মো. তারেক রহমান বলেন, ১০ বছর আগে উর্মী আপার মা-বাবা তাকে ছেড়ে যায়। সে নানির কাছেই বড় হয়েছে। তবে বিয়ের বয়স হলেও অসহায় নানা-নানি বিয়ে দিতে পারছিল না। উর্মী খাতুনের বিষয়টি জানতে পেরে মামুন বিশ্বাসের সাথে যোগাযোগ করা হয়। সাথে সাথে মামুন বিশ্বাস ফেসবুকে পোস্ট করেন। এরপর বিভিন্ন পেশার মানুষ টাকা পাঠানো শুরু করেন। এই বিয়ে একদম রাজকীয়ভাবে হয়েছে। কোনো কিছুর কমতি ছিলো না।

উর্মীর নানা মো. আব্দুল কুদ্দুস বলেন, রাজকীয় আয়োজনে নাতনির বিয়ে দিতে পারে আমি খুবই খুশি। সবাই আমার নাতনির জন্য দোয়া করবেন।

মামুন বিশ্বাস বলেন, আমি ফেসবুকের মাধ্যমেই উর্মীর বিষয়টি জানতে পারি। এরপর নানি বাড়িতে এসে কথা বলে বিস্তারিত লিখে পোস্ট করি। ফেসবুকের পোস্ট দেখে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে অনেক মানুষ সর্বমোট এক লাখ ৭ হাজার টাকা পাঠায়। সেই টাকা দিয়ে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। স্থানীয় এলাকাবাসী অনেক সহায়তা করেছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেসব বোন আছে, যাদের অর্থের অভাবে বিয়ে হচ্ছে না আমরা তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই।

এমএএস