দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে দেশ। শহরে-গ্রামে সবখানে উন্নতির ছোঁয়া। যোগাযোগ ব্যবস্থার অভুতপূর্ব উন্নয়ন বদলে দিয়েছে শহর-গ্রামের পার্থক্য। শহরের মতো নিভৃত পল্লিতেও পৌঁছে গেছে রড, সিমেন্ট, বালু। গড়ে উঠছে বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন উন্নয়ন অবকাঠামো। গ্রামের মেঠোপথও এখন কংক্রিটের তৈরি।

নদীমাতৃক অপরূপ বাংলায় এখন আগের মতো পুকুর, খাল-বিল, নদী-নালা নেই। আগের মতো খেয়া পারাপার করতে দেখা যায় না। সবুজের সমারোহে কাস্তে হাতে দলে দলে ধান কাটতে থাকা কৃষকদেরও চোখে পড়ে না। 

হারিয়ে গেছে গরুর পাল, গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছের গল্প। এখন গরুর পাল নিয়ে মাঠের দিকে রাখালকে ছুঁটতেও দেখা যায় না। অথচ একটা সময় নয়নাভিরাম গ্রাম বিমোহিত করত। সবুজ ছায়াঘেরা গ্রামবাংলার প্রকৃতি কাছে টানত। এখন দিন বদলের সঙ্গে সবই যেন নিখোঁজ। 

এখন কবির কবিতার মতো বৈশাখে নদীতে হাঁটু জল থাকে না। নদীর হাঁটু পানি মাড়িয়ে পার হয় না গরুর পাল আর গাড়ি। এখন নদীর বুক চিরে দাঁড়িয়েছে সেতু, সহজ হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। গ্রামীণ জনপদে বইছে অগ্রগতির ধারা। 

কবির কবিতা, শিল্পীর রং তুলি আর গানের সুরে শহরে থেকে দূরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের গ্রামগুলো এখনো চোখে ভাসে। কল্পনার জগতে চোখের পলকে ভেসে বেড়ায় গ্রামবাংলার প্রকৃতি। উন্নয়ন, উন্নতি আর অগ্রগতির এ যুগে শিল্পীর শিল্পকর্ম বাঁচিয়ে রাখছে গ্রামের প্রকৃতিকে। অনেকের মতো রং-তুলির আঁচড়ে জীবন্ত গ্রামবাংলাকে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন চারুশিল্পী নুর আলম।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী নুর আলম পড়ালেখা করেছেন চারুকলা অনুষদের চিত্রকলা, প্রাচ্যকলা ও ছাপচিত্র বিভাগে। ২০১৫ সালে স্নাতক ও ২০১৬ সালে একই বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটে এক বছর মেয়াদি বিএড কোর্স সম্পন্ন করেন। নুর আলমের গ্রামের বাড়ি রংপুরের পীরগাছা উপজেলার নটাবাড়ী গ্রামে।

ছোটবেলা থেকে ছবি আঁকার প্রতি নুরের আগ্রহের শেষ ছিল না। তার বাবা ও বড় ভাইও ছবি আঁকতেন। দুজনকেই অনুসরণ করতেন নুর আলম। ছোটবেলায় নতুন বই পেলে আগে বইয়ের ছবি দেখতেন। পড়ার চেয়ে ছবি দেখে বেশি আনন্দ পেতেন। খাতায়, বইয়ের পাশে ফাঁকা জায়গায় মনের কল্পনায় আঁকতেন ছবি। কাঠি দিয়ে মাটির ওপরে ছবি আঁকতেন, সেইসঙ্গে বিভিন্ন লেখার ফ্রন্ট আঁকার চেষ্টাও করতেন। এমনো সময় গেছে দিন-রাত মানুষের ব্যবহারিক খাতার ছবি এঁকেছেন। এভাবেই ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহ বাড়তে থাকে নুর আলমের।

যখন যা ভালো লেগেছে, রং তুলিতে তাই এঁকেছেন নুর আলম। এভাবেই আঁকতে আঁকতে শৈশব থেকে শিক্ষাজীবন পর্যন্ত সবধরনের ছবি রং তুলিতে তুলে ধরেছে। বর্তমানে বাংলার প্রকৃতি, রূপ বৈচিত্র্যকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরার প্রয়াসে কাজ করছেন নুর আলম।

বৈচিত্র্যময় গ্রামের প্রাকৃতিক রূপ, মাটির রসকে নিজের রং-তুলির ক্যানভাস থেকে বিশ্ব দরবারে ছড়িয়ে দিতে চায় এই চিত্রশিল্পী। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপচারিতায় নুর আলম বলেন, বর্তমানে শৈশবের সেই খেলার মাঠ, পুকুর-নদীতে সাঁতার কাটার ঘাট, নদী পারাপারের সেই সুখময় ঘাট আর নেই। বলতে গেলে শৈশবে আমরা যে গ্রামীণ সৌন্দর্যের ছোঁয়া পেয়েছি, এখন সেগুলো নিখোঁজ। বাংলার হারিয়ে যাওয়া সেই প্রাকৃতিক রূপ বৈচিত্র্যকে ক্যানভাসে ধরে রাখতে চাই। রং তুলিতে আবার ফুটিয়ে তুলতে চাই গ্রামবাংলার চিরচেনা দৃশ্যগুলো।

নুর আরও বলেন, কর্মজীবনে প্রবেশের বেশি দিন হয়নি। অনেকগুলো আঁকা ছবি রয়েছে। সেগুলো বাজারজাত করার মতো এখনো ভালো কোনো ব্যবস্থা করতে পারিনি। ছবি আঁকায় পেশাদারিত্ব থাকতে হবে। আমার আঁকা ছবিগুলো বিক্রি করতে চাই। এসব ছবির সাইজ ও কোয়ালিটির ওপর দাম নির্ভর করে। যে কেউ চাইলে আমাকে দিয়ে যেকোনো ছবি এঁকে নিতে পারেন। মাঝেমধ্যে অনলাইনে যে কয়েকটা ছবির অর্ডার পাই, তার সম্মানি নিয়ে রং, তুলি, ক্যানভাসসহ আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র কিনতেই সব শেষ হয়ে যায়।

ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে নুর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, চিত্রকর্মকে নিয়ে অনেক পরিকল্পনা রয়েছে। সেগুলো এখন কারো সঙ্গে শেয়ার করতে চাচ্ছি না। লক্ষ্য ঠিক করে আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে চাই। তবে বর্তমান পরিকল্পনা হচ্ছে এক হাজার বাস্তবধর্মী পেইন্টিং করার। বাস্তবধর্মী ছবি আঁকতে ভালো লাগে। এসব ছবির ভাষা সবাই বুঝতে পারে, অনুভবও করতে পারে। আমি চাই সবাই আমার ছবির দর্শক হোক।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এসপি