জুলাই ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে অংশ না নিয়েও ‘শহীদ’ হিসেবে তালিকাভুক্ত হন পটুয়াখালীর বশির সরদার নামে এক মৃত ব্যক্তি। সরকার থেকে অনুদান গ্রহণের পর অর্থের ভাগাভাগি নিয়ে পারিবারিক বিরোধের জেরে প্রকাশ্যে আসে এই ভুয়া শহীদ পরিচয়ের বিষয়টি।

নিহত বশির সরদার (৪০) পটুয়াখালী সদর উপজেলার খলিশাখালি গ্রামের সেকান্দার সরদারের ছোট ছেলে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলা শহরের নিউমার্কেট এলাকায় একটি চায়ের দোকান চালাতেন। তবে পরিবার দাবি করে, গত বছরের ৩ জুলাই তিনি গণআন্দোলনে অংশ নিয়ে আহত হন এবং পরবর্তী সময়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। এই তথ্যের ভিত্তিতে তাকে শহীদ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়।

এরপর জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা এবং সরকারের পক্ষ থেকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র প্রদান করা হয় নিহত বশিরের পরিবারকে। আর এই অনুদানের টাকা নিয়েই বাধে বিপত্তি। অভিযোগ রয়েছে অনুদানের টাকা বশিরের স্ত্রী রেবা আক্তার একাই ভোগ করছেন। এ কারণেই নিহতের বড় ভাই নাসির প্রকৃত তথ্য তুলে ধরে জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন।

অভিযোগে বলা হয়, ২০২৪ সালের ৩ জুলাই পায়ে লোহা ঢুকে তিনি গুরুতর আহত হন। পরে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই বছরের ১৫ নভেম্বর তিনি মারা যান। আর্থিক অনুদান পাওয়ার আশাতেই তারা মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন। 

জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, অভিযোগের পর ২৩ জুলাই জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন বিষয়টি তদন্ত করে শহীদের তালিকা থেকে বশির সরদারের নাম বাতিলের সুপারিশ করেন এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে একটি চিঠি পাঠান। একই সঙ্গে সরকারের দেওয়া সঞ্চয়পত্র স্থগিতের সুপারিশও করেছেন।

বশির সরদারের বড় ভাই নাসির সরদার ভুল তথ্য দিয়ে শহীদের তালিকায় নিজের ভাইয়ের নাম অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি স্বীকার করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ভাইয়ের চিকিৎসায় প্রচুর টাকা খরচ হয়েছে যার মধ্যে ৫ লাখ টাকাই দিয়েছে আমার বাবা। এছাড়াও অনেকে টাকা ঋণগ্রস্ত হই। ঋণের টাকা পরিশোধ করতে বশিরের স্ত্রী জেলা প্রশাসনকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে সরকারি অনুদান থেকে পাওয়া ১২ লাখ টাকা বশিরের স্ত্রী একাই ভোগ করছেন। এজন্যই আমি প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করে অভিযোগ দিয়েছি।

অভিযোগের কথা অস্বীকার করে নিহত বশিরের স্ত্রী রেবা আক্তার বলেন, আমার স্বামী আহত হওয়ার পর চিকিৎসায় প্রচুর ঋণ করতে হয়েছে। স্বামী মারা যাওয়ার পর দুই সন্তানকে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি। নাসির সরদারের পরামর্শেই আমি ভুল তথ্য দিয়েছিলাম, কিন্তু পরে তারাই পুরো টাকা চাইলে আমি দিতে অস্বীকৃতি জানাই। তখনই নাসির ভাই ডিসিকে অভিযোগ দেন।

এ বিষয়ে পটুয়াখালী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছাত্র প্রতিনিধি সজিবুল ইসলাম সালমান বলেন, ৩ জুলাই বশির পায়ে লোহা বিদ্ধ হয়ে আহত হন, তবে তাকে আন্দোলনের আহত হিসেবে দেখিয়ে চিকিৎসার সময় মিথ্যা তথ্য লিপিবদ্ধ করে শহীদের স্বীকৃতি নেয় পরিবার। এতে সরকার ও জেলা প্রশাসন প্রতারিত হয়েছে।

জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মুহাম্মদ আরেফিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পর আমরা নাসির সরদার ও বসি সরদারের স্ত্রী রেবা বেগমকে ডেকেছিলাম, তারা দুজনেই মিথ্যা তথ্য প্রদানের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। প্রাথমিক তদন্তের পর আমরা শহীদ জুলাইযোদ্ধার নামের তালিকা থেকে তার নাম বাদ দেওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় বরাবর সুপারিশ করেছি। একই সঙ্গে তার নামে ইস্যু করা সঞ্চয়পত্রও স্থগিতের জন্য সুপারিশসহ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।

এমন ঘটনার পর প্রশ্ন উঠেছে যাচাই-বাছাই ছাড়া শহীদের তালিকা প্রণয়ন কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে? একইসাথে, সরকারের দেওয়া অনুদানের সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং নৈতিকতা রক্ষার দিকেও নতুন করে দৃষ্টি দেওয়া জরুরি বলে মনে করছে সচেতনরা।

রায়হান/এমএএস