‘হঠাৎ কী যেন এসে আঘাত করলো দাঁতে। মুহূর্তেই ব্যথা ছড়িয়ে পড়ল পুরো মুখমণ্ডলে। হাত দিয়ে ছুঁতেই দেখি দাঁত ভেঙে গেছে। তারপরই সব অন্ধকার। যখন চেতনা ফিরল, তখন শরীর রক্তে ভেজা, চোখ ঝাপসা, মাথা কাঁপছে। বুঝলাম, শরীরের নানা জায়গায় গুলি লেগেছে। আশপাশে তাকিয়ে দেখি সব নিথর দেহ। আমাকেও মৃত ভেবে ফেলে রাখা হয়েছে লাশের সঙ্গে। তখনই ফ্যাকাসে কণ্ঠে শুধু বলেছি আমাকে বাঁচাও! আমি বেঁচে আছি!’

জুলাই অভ্যুত্থানের এই ভয়ংকর অভিজ্ঞতার বর্ণনাই দিচ্ছিলেন সিরাজগঞ্জে আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ নাটোরের যুবক আব্দুল্লাহ আল বাকি মিঠু (৩২)। 

নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার হাটগোবিন্দপুর গ্রামের বাড়িতে কথা হয় তার সঙ্গে। কৃষক আব্দুল খালেক ও গৃহিনী জুলেখা খাতুনের একমাত্র ছেলে মিঠু। 

বরিশাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি থেকে ২০১৫ সালে মেডিকেল রেডিওলজি বিভাগে পাস করার পর মিঠু কাজ করেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। জুলাই আন্দোলনের এক বছর আগে থেকে তিনি সিরাজগঞ্জের বেতিল বাসস্ট্যান্ড এলাকার ড্যাফোডিল স্পেশালাইজড হাসপাতালে সিটিস্ক্যান অপারেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

২০২৪ সালের ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানার কেজির মোড়ে আন্দোলনে যোগ দিতে গিয়েই গুলিবিদ্ধ হন তিনি। ছররা গুলির আঘাতে শরীর হয় ক্ষতবিক্ষত। পরে স্থানীয়রা উদ্ধার করে সিরাজগঞ্জের খাজা ইউনুস আলী হাসপাতালে নিয়ে যান। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, হাসপাতালে নেওয়ার পর মৃত ভেবে লাশের পাশে ফেলে রাখা হয়েছিল তাকে। জ্ঞান ফিরলে মিঠু বুঝতে পারে সে লাশের সাথে মেঝেতে পড়ে আছে। জ্ঞান ফিরতেই তার চিৎকারে ডাক্তাররা এগিয়ে আসে। শুরু হয় তার চিকিৎসা। সেখানে তার শরীরের বিভিন্নস্থানে থাকা কিছু ছররা গুলি অপারেশন করে বের করা হয়। চোখ, মুখ ও কপালে আটকে থাকা গুলিগুলো তখনও শরীরে রয়ে যায়। 

পরদিন ৫ আগস্ট তাকে ঢাকার জাতীয় চক্ষু হাসপাতালে আনা হয়। বাম চোখে অস্ত্রোপচার শেষে ডাক্তাররা জানান, পরবর্তী অস্ত্রোপচারের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এরপর কয়েকদফা অস্ত্রোপচার করেও তেমন কোনো লাভ হয়নি। পরে সরকারের সহায়তায় মিঠুকে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয় সিঙ্গাপুর। সেখানে চোখ ও মুখে থাকা আটটি ছররা গুলির মধ্যে চারটি গুলি বের করা সম্ভব হয়, যার একটি ছিল ডান চোখের পাতায়। তবে মুখে ও বাম চোখের ভেতরে থাকা ছররা গুলি এখনো শরীরে রয়ে গেছে। 

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, এসব গুলি আর বের করা সম্ভব না। গুলির আঘাতে বাম চোখের দৃষ্টি একেবারেই হারিয়েছেন মিঠু। এখনো মাঝে মাঝে কাতর হয়ে পড়েন সেই চোখের যন্ত্রণায়। যন্ত্রণা এত তীব্র যে, কখনো কখনো ডান চোখের দৃষ্টিও ঝাপসা হয়ে আসে। চোখ দিয়ে পানি পড়ে, প্রচণ্ড ব্যথায় অনেক সময় কিছুই দেখা যায় না।

এই অবস্থায়ও থেমে থাকেননি মিঠু। চিকিৎসা ও সংসারের খরচ মেটাতে তাকে পুনরায় কাজে ফিরতে হয়েছে। সেই পুরনো কর্মস্থলে, যেখানে আগে ছিলেন একদম স্বাভাবিক। এবার সেখানে ফিরেছেন এক চোখের দৃষ্টি হারিয়ে। দেশের আলো ফেরাতে চোখের আলো বিসর্জন দেওয়ার এক যোদ্ধা হিসেবে।

মিঠুর বাবা আব্দুল খালেক জানান, তিনি ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে আক্রান্ত। হার্টে রিং পরানো আছে, কাজকর্ম করতে পারেন না। মিঠুই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। অসুস্থ বাবা-মা আর পুরো সংসারের দায়িত্ব মিঠুর কাঁধেই। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেমে যায় সংসারের উপার্জন। ধার দেনা করে ছেলের চিকিৎসা করতে হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় থেকে ২ লাখ টাকা পেয়েছেন। তবে ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচ আর এক চোখের দৃষ্টি হারানোর তুলনায় যা অপ্রতুল।
 
মা জুলেখা খাতুন বলেন, আমার একটাই ছেলে। দেশের জন্য আন্দোলনে গিয়ে ছেলের এক চোখে এখন আলো নেই। অনেক চিকিৎসা করানো হয়েছে। কোনো কিছুতেই চোখের দৃষ্টি ফেরানো যায়নি। ছেলেটার এক চোখ আর কোনোদিনও ভালো হবেনা। 

মিঠু বলেন, দেশের জন্য আন্দোলনে গিয়ে চোখ হারিয়েছি। অথচ এখন যে যার মতো দেশের দায়িত্ব নিতে ব্যস্ত। এত অনুষ্ঠান হয় আমাদেরও ইচ্ছে করে সেসব আয়োজনে থাকতে, উপভোগ করতে। কিন্তু আমার চোখের যেই অবস্থা রোদে তাকাতেই পারি না। দেখব কিভাবে? নিজের দৃষ্টি হারালেও দেশকে যে আলো দিতে পেরেছি এটাই আনন্দের। শুধু চাই দেশটা ভালো থাকুক। 

নাটোরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. আবুল হায়াত বলেন, সরকার জুলাই আন্দোলনে আহত ও শহীদ পরিবারদের আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি পুর্নবাসনের বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের সার্বিক সহযোগিতায় জেলা প্রশাসন পাশে থাকবে।

আশিকুর রহমান/আরকে