বর্ষার সময় হলেই শতবর্ষী নৌকার হাটে শুরু হয় ক্রেতা-বিক্রেতা ও পর্যটকদের পদচারণ। বিক্রেতা ভাসতে ভাসতে বের হন নৌকা নিয়ে আবার ক্রেতা নৌকা কিনে নিয়ে যান ভাসতে ভাসতে। আর কেউ নিয়ে যায় ভ্যান বা পিকআপে করে। ক্রেতার সঙ্গে বিক্রেতার দামের বনিবনা হলেই নৌকা নিয়ে ছোটেন সবাই।

শত বছরের বেশি সময় ধরে চলা ঐতিহ্যবাহী নৌকার হাটটি বসে পিরোজপুরের নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠী) উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানা এলাকার মনোপাশায় সন্ধ্যা নদীর শাখার খালের পাড়ে ও পানিতে। স্থানীয় কৃষক, জেলে ও গৃহস্থরা ছাড়াও বরিশালের বানারীপাড়া, উজিরপুর, ঝালকাঠি সদর উপজেলা, রাজাপুর উপজেলা ও পিরোজপুরের কাউখালী, নাজিরপুর উপজেলা থেকে নৌকা কিনতে মানুষ এ হাটে আসে।

জানা যায়, সন্ধ্যা নদীর পশ্চিমপাড়ের গ্রাম ডুবি, কাটাখালী, একতা ও চামীসহ ৬টি গ্রামের তিন শতাধিক পরিবার নৌকা তৈরির কজের সঙ্গে জড়িত। নৌকা তৈরির শুরুর দিকে সুন্দরী কাঠ সহজলভ্য হওয়ায় সেই কাঠ দিয়ে তৈরি হতো নৌকা। এখন সুন্দরী কাঠ দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় কড়ই, রেইনট্রি, চম্বল ও মেহগনি কাঠ দিয়ে নৌকা তৈরি করা হয়। চাম্বলের ৮ হাত নৌকা ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়।

বর্তমানে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় ও করোনা পরিস্থিতির কারণে ক্রেতাশূন্যতায় ভুগছে পিরোজপুরের নেছারাবাদের ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী নৌকার হাট। আবার বছর ঘুরতে না ঘুরতেই হাটের ইজারা মূল্য বৃদ্ধি ও ইজারাদারদের অতিরিক্ত মূল্য আদায়ের কারণে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন নৌকার ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ীদের দাবি, বহু যুগের ঐতিহ্যবাহী এই নৌকার হাটকে পর্যটনশিল্পে পরিণত করতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি ইজারা মূল্যও কমানো প্রয়োজন।

সরেজমিনে হাটে দেখা যায়, পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলা সদর থেকে ৮ কিলোমিটার পূর্ব দিকে আটঘর বাজার। বছরের জ্যৈষ্ঠ থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত দক্ষিণাঞ্চলের এ ঐতিহ্যবাহী নৌকার সবচেয়ে বড় হাটটি বসে এখানে। ক্রেতারা ঘুরে ঘুরে দরদাম করে পছন্দের নৌকা কিনে বাড়ি ফিরছেন। কেউ নৌকা বেয়ে আবার কেউ ইঞ্জিনচালিত ভ্যানে তুলে নৌকা নিয়ে বাড়ি ফিরছেন।

আটঘরের নৌকার হাটটিতে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ক্রেতা ও বিক্রেতাদের দরাদরিতে চলে নৌকা বিক্রি। তবে হাটটি জমজমাট থাকে সকাল ১০ থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত। বইঠাও বিক্রি হয় নৌকার পাশাপাশি এই হাটে।

বর্ষা মৌসুমে গ্রামগুলোয় গিয়ে চোখে পড়ে, বাড়ির আঙিনায় নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগররা। বর্ষা মৌসুমে আটঘর খালের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ভাসমান এই হাট জমজমাট হয়ে ওঠে। এ খালে সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার বসে ডিঙি নৌকার হাট।

হাটে নৌকা কিনতে আসা গোলাম ফারুক ঢাকা পোস্টকে বলেন, নৌকা একটা কিনছি ২ হাজার ২০০ টাকায়। বাড়ি থেকে রাস্তায় ওঠার জন্য ব্যবহার করা হয় নৌকা। আবার মাছ ধরা ও বিভিন্ন সময় বীজ, সবজি ও ফসল বিক্রির জন্য ব্যবহার করি।

নৌকাক্রেতা আলাউদ্দিন বলেন, আজকে নৌকা কিনতে হাটে আসছি। তুলনমূলক যে দাম নৌকার, তা ক্রেতাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারপর আসলাম বইঠা কিনতে। এখানে অনেক বইঠা আছে। তাতেও যে দাম বলে সেটি আমাদের কেনার সাধ্যের বাইরে।

নৌকা ক্রেতা আব্দুল খালেক বলেন, বারইয়া থেকে আইসা নৌকা কিনছি। ২৫০০ টাকা নৌকা। চোতায় (রসিদ) রাখছে ২৫০ টাকা। ভ্যানে ২০০ টাকা।

নৌকা বিক্রেতা বাপ্পি মিত্র ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত। লোকজন এলেও কেনার কেউ নাই। আমরা কয়েকটি ব্যবসায়ী ১০০-এর বেশি নৌকা নিয়ে আসছি। আমাদের কাছে ২ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দামের নৌকা আছে।

বিক্রেতা সেলিম খান বলেন, নৌকা বিক্রি করতে আসছি। অনেক নৌকা আনছি। ক্রেতারা দাম কম বলে আমরা যে টাকা খরচ করি বা যে দাম চাই, তার থেকে ৪০০-৫০০ টাকা কম বলে দাম। নৌকা বিক্রির কোনো উপায় নাই। নৌকা নিয়ে এখন বাড়ি ফিরে যেতে হবে।

নেছারাবাদ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোশারেফ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, পিরোজপুর জেলায় যে কয়টি ঐতিহ্যবাহী সম্পদ রয়েছে, তার মধ্যে এই শতবর্ষী নৌকার হাটটি অন্যতম। আটঘরের এই নৌকার হাটটি সবার কাছে পরিচিত ও বিখ্যাত।

আরও একটি কারণে নৌকা জনপ্রিয়। সেটা হলো পেয়ারা বাগান। এই পেয়ারা ফলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই নৌকা ব্যবহার করেন। আবার পর্যটকরা নৌকায় ঘুরে আনন্দ উপভোগ করেন।

ইউএনও বলেন, ইতোমধ্যে আমরা পর্যটন করপোরেশনকে জানিয়েছি যে নেছারাবাদ উপজেলার সব সম্ভাবনাময় ঐতিহ্যের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে। পর্যটনের এই শিল্পকে কীভাবে আরও সম্প্রসারিত করা যায়, সে বিষয়ে পর্যটন করপোরেশনের সঙ্গে কথা বলে উদ্যোগ নেব।

এনএ