করোনা পজিটিভ হলেই মেলে ছুটি
রাজশাহীতে বেড়েছে করোনার প্রকোপ। প্রতিদিনই মৃতের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন নাম। করোনার সম্মুখসারির যোদ্ধাদের বিরাম নেই একবিন্দুও। জরুরি প্রয়োজনেও ছুটি মেলে না রাজশাহী মেডিকেল কলেজে (রামেক) কর্মরত আউটসোর্সিং কর্মীদের।
নাওয়া-খাওয়া ভুলে রাতদিন এক করে নমুনা সংগ্রহের কাজ করছেন এসব কর্মী। করোনার সঙ্গে বাস করেও আইসোলেশনে থাকা কিংবা ভালো খাবারের বন্দোবস্ত নেই তাদের জন্য। বেতন নেই দীর্ঘ পাঁচ মাস। চাপা কষ্ট থাকলেও কাজে ‘না’ বলেন না এসব কর্মী।
বিজ্ঞাপন
স্বাস্থ্য দফতরের আউটসোর্সিং কর্মী হুমায়ুন কবীর। অ্যাটেনডেন্ট পদে তিনি নিযুক্ত রাজশাহী মেডিকেল কলেজে। দায়িত্ব পালন করেন করোনার নমুনা সংগ্রহকারী হিসেবে এখানকার আরটিপিসিআর ল্যাবে।
তিনি বলেন, করোনা যুদ্ধে নেমেও তাদের প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনের ব্যবস্থা নেই। দিন শেষে পরিবারের কাছে ফিরে যাচ্ছেন। ঝুঁকির মুখে পড়ছে পুরো পরিবার। আইসোলেশনে থাকার ব্যবস্থা থাকলে এই শঙ্কা থাকতো না।
বিজ্ঞাপন
হুমায়ুন কবীর বলেন, লোকবল কম। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের সাপ্তাহিক ছুটি নেই। পরিবারের সঙ্গে আলাদা সময় কাটানোর জন্য ছুটি বলতে বড় উৎসব। বিশেষ করে দুই ঈদ। যেহেতু ঈদের দিনও ল্যাব চলে সেকারণে কর্মীদের ভাগ করে একটা দল ছুটি পায়। আরেক দল পরের ঈদের জন্য অপেক্ষা করেন। পরিস্থিতির বাস্তবতায় ছুটি মেলে তখনই, যখন তারা আক্রান্ত হন করোনায়। তাদের কাছে টানা ছুটি মানে করোনা পজিটিভ, নইলে না।
হুমায়ুন কবীরের মতো অন্তত ৯ জন আউটসোর্সিং কর্মী রাজশাহী মেডিকেলে টেকনোলজিস্ট ও ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট পদে নিযুক্ত। এদেরই একজন আব্দুল্লাহ আল নোমান। ঝিনাইদহ থেকে এসে অস্থায়ী নিবাস গড়েছেন রাজশাহীতে।
করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির নমুনা নিতে যখন অন্য সহকর্মীরা আপত্তি তোলেন, তখনই ভরসা নোমান। যেখানে যে অবস্থায় থাকুন না কেন তাকে ফোন দিয়ে ডেকে নেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
ফোন পেয়ে দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছে যান নোমান। কারণ তিনি যত বিলম্ব করবেন, ততটা সময় মরদেহ পড়ে থাকবে। প্রিয়জন হারানো স্বজনদের অপেক্ষাও ততটা বাড়বে।
আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, এটি এমন একটি পেশা যার কারণে পাতের ভাত থেকে হাত তুলে বেরিয়ে যাবার ঘটনা তার বহুবার ঘটেছে। এখন আপনি বলতে পারেন আর কেউ কি ছিল না? হ্যাঁ ছিল। কিন্তু আমাদের টিমে মরদেহ থেকে কেউই নমুনা নিতে রাজি হয় না।
নমুনা সংগ্রহে গিয়ে তিনবার তার শরীরে বাসা বেঁধেছিল প্রাণঘাতি করোনা। কিন্তু বার বারই হার মেনেছে। নোমান বলেন, তার কাজের ধরনটা হলো সরাসরি কোভিড রোগীদের সংস্পর্শে গিয়ে। এখানে তাদের জীবনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। সংক্রমণ যতটাই বাড়ুক, ঝুঁকি যতই থাক, নমুনা সংগ্রহের কাজটা করতেই হবে। ভয় পেলে চলবে না।
একই ভাষ্য আরেক আউটসোর্সিং কর্মী সোহেল রানা রুবেলেরও। তিনি জানান, প্রতিদিনই রাজশাহী মেডিকেলে কলেজ পয়েন্ট ও নগরীর বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করেন। কিন্তু যাতায়াত খরচটুকুও দেওয়া হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই ব্যয় করতে হয় নিজেদের পকেট থেকে। আবার আরটিপিসিআর ল্যাবেও কাজ করেন। অথচ তাদের সময়মতো মেলে না বেতন। একাধিকবার করোনা আক্রান্ত হলেও তাদের জন্য চিকিৎসা বা ঝুঁকি ভাতা বরাদ্দ নেই। অস্থায়ী কর্মী হওয়ায় বৈষম্যের শিকার তারা।
এদিকে ঝুঁকি জেনেও রাজশাহীতে করোনার নমুনা সংগ্রহকারীর তালিকায় নাম লিখিয়েছেন অন্তত ৩০ জন স্বেচ্ছাসেবী। তারা কোনো ধরনের নিয়োগ ছাড়াই কাজ করছেন দিনের পর দিন। তবে সরকারি ও বেসরকারি অনুদান থেকে তাদের সামান্য কিছু সম্মানি দেওয়ার কথাও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এনিয়ে আক্ষেপ নেই স্বেচ্ছাসেবী রুবিনা পারভীনের। তিনি জানান, করোনা সংক্রমণের শুরুতে নমুনা সংগ্রহের জন্য যখন কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন নিজেরাই মনস্থির করেন তারা মানবিক বিবেচনায় কাজটি করবেন। যেহেতু তার পড়াশোনা প্যারামেডিকেলে, চিন্তাটি কার্যকর করতে সময় লাগেনি। গতবছর প্রশিক্ষণ নিয়ে সিটি করপোরেশনের হয়ে নমুনা সংগ্রহ শুরু করেন তারা। বিগত কিছু দিন ধরে সিটি করপোরেশন তাদের মাসে ১২ হাজার টাকা করে ভাতা দেওয়া শুরু করেছে।
রাজশাহীতে করোনার প্রকোপ বাড়ায় বর্তমানে ১৩টি পয়েন্টে র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট করছে রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক)। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরাও নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার কাজ করছেন।
তারা জানান, নিয়মিত সম্মানির বাইরে এর জন্য আলাদা করে কোনো ভাতা দেওয়া হয় না। যেহেতু স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মী, সে কারণে এই মহামারিকালে মানবিক বিবেচনা বোধ থেকে সরাসরি কোভিড রোগীদের সংস্পর্শে গিয়ে কাজ করছেন এই স্বেচ্ছাসেবীরা।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের রাজশাহী জেলা সভাপতি ডা. চিন্ময় কান্তি দাস বলেন, মহামারির এই সময়ে নমুনা সংগ্রকারীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো উচিত স্বাস্থ্য বিভাগের। এবং সেটি জরুরিভাবেই করা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে কথা বলতে বিভাগীয় স্বাস্থ্য দফতরের পরিচালক ডা. হাবিবুল আহসান তালুকদারের মুঠোফোনে কয়েক দফা যোগাযোগ করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে দফতরের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. রোজী আরা খাতুন জানান, সম্প্রতি তিনি এখানে যোগদান করেছেন। বিষয়টি তার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানান তিনি।
ফেরদৌস সিদ্দিকী/আরএআর