প্রায় ৫১ বছর ধরে বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাওয়া ৮৬ বছর বয়সী ব্রিটিশ নাগরিক জিলিয়ান এম রোজ।  তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে ‘মানবতার মা’ এবং ‘মাদার তেরেসা’ নামে পরিচিত। ব্রিটিশ নাগরিক হলেও তার চলন-বলন ও সাবলীল বাংলা ভাষায় কথা বলার ধরন দেখে হঠাৎ করে তাকে বাংলাদেশি বলেই মনে হতে পারে। এত বছর ধরে প্রান্তিক মানুষের সেবার পর তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে এ দেশের মাটিতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে চান।

১৯৩৯ সালে ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণকারী জিলিয়ান এম রোজ ১৯৬৪ সালে প্রথম বরিশালে মিশনারি হিসেবে যোগদান করেন। একবার নিজ দেশে ফিরে গেলেও বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে তিনি ১৯৭৪ সালে আবার ফিরে আসেন। এরপর ১৯৮১ সালে মায়ের সেবা করতে ইংল্যান্ডে গিয়ে সেবিকা হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন। ফিরে এসে প্রথমে খুলনা এবং মুজিবনগরের বল্লভপুর হাসপাতালে যাওয়া আসা শুরু করেন। শেষবারের মতো তিনি ১৯৯৬ সাল থেকে মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার বল্লভপুর হাসপাতালের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি এক সময় কোনো চিকিৎসক ছাড়া একাই রোগীদের সেবা করতেন। বর্তমানে তার সঙ্গে কয়েকজন সেবিকা কাজ করছেন এবং পাশেই তিনি একটি বৃদ্ধাশ্রমও গড়ে তুলেছেন। তখন থেকেই তিনি মুজিবনগরের প্রান্তিক জনগোষ্টীর সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

বল্লভপুর হাসপাতালের নার্স হান্না মন্ডল জানান, সিস্টার জিলিয়ান রোজ নিজের জীবন বাংলাদেশের মানুষের জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছেন এবং সর্বদা তিনি মানুষের সেবায় নিয়োজিত থাকেন, কখনো রোগীদের ওপর বিরক্ত হন না। 

হাসপাতালের এডমিন বিনিময় বিশ্বাস বলেন, সিস্টার জিলিয়ান এম রোজকে পেয়ে খুশি হাসপাতালের স্টাফ এবং এলাকাবাসী। রোগীরা তাকে মানবতার মা এবং মাদার তেরেসা হিসেবেও আখ্যায়িত করে। দুই মাস আগে এই হাসপাতালে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম পরিদর্শন করে জিলিয়ান এম রোজের সঙ্গে কথা বলে তার নাগরিকত্ব ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন। যদি রোজ নাগরিকত্ব পান তাহলে দেশের মানুষের সেবা করে এই দেশে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে চান।

স্থানীয় রোগী সমর বিশ্বাস বলেন, জিলিয়ান রোজ খুব গুরুত্ব সহকারে ডেলিভারি, ডায়াবেটিস, টাইফয়েড, জন্ডিস, ডায়রিয়াসহ শিশুদের চিকিৎসা দেন এবং খুব কম সময়ে রোগ ভালো হয়।

সিস্টার জিলিয়ান এম রোজ জানান, বাংলাদেশের প্রান্তিক, অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সেবা দিতে গিয়েই তিনি এ দেশের প্রেমে পড়ে যান। অনেক চেষ্টার পরও তিনি এখনও বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পাননি। নাগরিকত্ব পেলে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এদেশের মানুষের সেবাই নিয়োজিত থাকতে চান। ইতোমধ্যে তিনি বাংলাদেশ সরকারের নিকট নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন।

জাতীয় যুবশক্তি (এনসিপি) কেন্দ্রীয় সংগঠক মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, জিলিয়ান এম রোজ বহুবার চেষ্টা করেও নাগরিকত্ব পাননি। পরবর্তীতে গত জুলাই মাসে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আশ্বাস দেন। সিদ্ধান্ত মোতাবেক, স্থানীয়ভাবে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বরাবর নাগরিকত্বের জন্য এরই মধ্যে আবেদন করা হয়েছে।

মেহেরপুর জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ আবদুল ছালাম সম্প্রতি বল্লভপুর হাসপাতাল পরিদর্শন করে জিলিয়ান এম রোজের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। জেলা প্রশাসক বলেন, জিলিয়ান রোজ তার জীবনের বেশিরভাগ সময় বাংলাদেশের মানুষের সেবায় ব্যয় করেছেন এবং এই বয়সেও নিরলসভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে তাকে সব সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেন।

 নিজের দেশের সব সুযোগ-সুবিধা ত্যাগ করে এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে তিনি মানব সেবায় যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা সত্যিই বিরল। আজও তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব না পেলেও, স্থানীয় মানুষের হৃদয়ের নাগরিক হয়ে উঠেছেন।

আরকে