এক পা হারিয়েও থেমে নেই সোহরাব
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার কুয়াকাটার জেলে সোহরাব। ১০ বছর আগে সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জনের চেয়েও ভয়াবহ এক ঝড় বয়ে যায় তার জীবনে। এক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি একটি পা হারান। দুর্ঘটনার পর চিকিৎসার জন্য যে সামান্য সঞ্চয় এবং সম্পদ ছিল, তাও ফুরিয়ে যায়। তখন অনেকেই ভেবেছিলেন, সোহরাব হয়তো আর জীবনযুদ্ধে ফিরতে পারবে না।
কিন্তু সবাইকে ভুল প্রমাণ করে তিনি আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। এখন এক পায়ে ভর দিয়েই ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে চলেন।
বিজ্ঞাপন
জেলে সোহরাবের জন্ম থেকেই সমুদ্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক। ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে নৌকায় সমুদ্রে যেতেন তিনি, জাল ফেলতেন, মাছ ধরতেন। ২০১৫ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় পা হারানোর পরও সমুদ্রই তার আয়ের একমাত্র উৎস। মাথার ওপর দুটি এনজিওর ঋণের বোঝা আর আড়ৎদারের দাদনের বোঝায় জর্জরিত সোহরাবের বসবাস কুয়াকাটা পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের জেলে পল্লীর সরকারি আশ্রয়ণের ঘরে।
জানা যায়, প্রতিদিন ভোরে ক্রাচে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তিনি যান সমুদ্রের পাড়ে। ঝুঁকি থাকলেও পেটের দায়ে আর সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি ছুটে যান বিশাল সমুদ্রের বুকে। এক পায়ের ওপর ভরসা করে ছোট্ট নৌকাটি নিয়ে ছুটে যান গভীর সমুদ্রে। নৌকায় থাকা ইঞ্জিন চালু করেন নিজেই। ইঞ্জিন চালু হয়ে গেলেই ছুটে যান নৌকার হাল ধরতে। এরপর শুরু হয় সমুদ্রের বড় বড় ঢেউয়ের সঙ্গে তার যুদ্ধ। এভাবেই কেটে যাচ্ছে তার কষ্টের জীবন।
বিজ্ঞাপন
সোহরাবের সংসারে আছেন বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী আর তিন সন্তান। ৮ বছর বয়সী বড় ছেলেটি সংসারের খরচ যোগাতে সৈকতে চায়ের দোকান দিয়ে বাবাকে একটু সাহায্যের চেষ্টা করে। মেঝ ছেলেটা বই হাতে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছেন, তবে সেটা কত দিন পারবে তা নিয়েও রয়েছে সংশয়। আর আছে ৭ মাস বয়সের ছোট এক ছেলে। স্ত্রী হালিমার, তিন সন্তান এবং শ্বশুর-শাশুড়িসহ ঘর সামলাতেই দিন কেটে যায় তার। সংসার চলে অনেক কষ্টে। ঠিকমতো খাবার না জুটলেও, কখনো কারো কাছে হাত পাতেন না সোহরাব। আত্মসম্মান আর অদম্য ইচ্ছাশক্তিই তার সবচেয়ে বড় পুঁজি।
সোহরাবের বাবা কালাম মাঝি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এক সড়ক দুর্ঘটনায় আমার ছেলের পায়ে রড ঢুকে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার জানায় পা রাখতে গেলে ক্যান্সারের ঝুঁকি রয়েছে। সেজন্য ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য পা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর থেকেই শুরু হয় তার প্রতিবন্ধী জীবন। স্ত্রী, তিন সন্তানসহ পরিবারের ৭ সদস্যদের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন গভীর সমুদ্রে মাছ শিকারে যায় আমার ছেলে। যখন সমুদ্রে যায় তখন আমি অথবা আমার স্ত্রী একজন গিয়ে বসে থাকি সাগরের পারে ছেলের অপেক্ষায়, সোহরাব ফিরে আসলে তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরি।
তিনি আরও বলেন, আমি গরিব মানুষ। যতটুকু সম্পদ ছিল তা আমার ছেলের চিকিৎসার জন্য খরচ করেছি। এখন আমি একবারে নিঃস্ব। আমি চাই সমাজের বিত্তবান শ্রেণির মানুষ অথবা সরকারের তরফ থেকে আমার ছেলেকে যেন একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়। বয়সের ভার এবং শারীরিক নানা সমস্যায় আমিও এখন অনেটা ক্লান্ত।
এই সংগ্রামী জীবন চলা অবস্থায়ও সোহরাবের স্ত্রী হালিমা বেগমের নেই হতাশা নেই কোন অভিযোগ । তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিন সন্তান-স্বামীসহ সবাইকে নিয়ে অনেক ভালো আছি। হয়তো অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা কষ্টে আছি, তবে সেটি আমার কাছে কোনো কষ্ট না। আমার শুধু কষ্ট একটাই আমার স্বামীর পা নেই। ২০১৫ সালে আমার স্বামী পা হারায়, আর আমাদের বিয়ে হয় ২০১৬ সালে। আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসতাম, তাই এই দুর্ঘটনার পরেও আমি তাকে ছেড়ে যাইনি।
সোহরাবের মা ফাতেমা বেগম বলেন, হাসপাতালের বিছানায় যখন আমার ছেলে ছটপট করছিল, তখন সে বলত মা আমি পা ছাড়া বাঁচতে চাই না।কিন্তু আমি তো মা, মায়ের মন কি আর কিছু বুঝতে চায়। ছেলের জন্য সব দিয়ে চিকিৎসা চালিয়েছি। আমি শুধু আল্লাহর কাছে চেয়েছি আমার ছেলেটা বেঁচে থাকুক।
কুয়াকাটার জেলে নেতা নিজাম শেখ বলেন, কালাম মাঝির ছেলে সোহরাব খুবই পরিশ্রমী একটি ছেলে। এত বড় দুর্ঘটনার পরও সে থেমে থাকেনি, নিজের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে বেঁচে আছে। তার বাবাও পেশায় একজন জেলে, তবে বয়সের ভারে এবং ছেলের শোকে এখন ভারী কোনো কাজ করতে পারছে না তিনি। আমরা জেলে সমিতি থেকে ওর পাশে থাকি সব সময়।
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) কাউছার হামিদ বলেন, সোহরাবের জীবনের গল্প শুধু একটি ব্যক্তির সংগ্রাম নয়। এটি হাজারো প্রতিবন্ধকতাকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে চলা এক সাহসী মানুষের প্রতিচ্ছবি। তার মতো মানুষেরাই প্রমাণ করে, শারীরিক সীমাবদ্ধতায় মানসিক শক্তি হারাতে নেই। সোহরাবের মতো মানুষদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের সবার দায়িত্ব। সোহরাব একজন সরকারি নিবন্ধিত জেলে, তার জেলে কার্ড রয়েছে। বছরে তিনবার সে পর্যায়ক্রমে সরকারি চাল সহায়তা পান। কিন্তু এটা তার জন্য যথেষ্ট নয়। আমরা তার জন্য আরও ভালো কিছু করে দেওয়ার চেষ্টা করছি।
আরকে