খুলনার আদর্শ শিক্ষক মো. নজরুল ইসলাম বাবুল। বিকে স্কুলের গণিতের শিক্ষক তিনি। শিক্ষকতা পেশায় শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সহকর্মীদের হৃদয়ে স্থান জুড়ে নিয়েছেন। একদিকে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার বিষয়ে যেমন কঠোর ছিলেন, অন্যদিকে স্কুলে হাস্যরসে ভরা ছিল তার ক্লাস। গণিতে এই শিক্ষকের সুখ্যাতি রয়েছে মানুষের মুখে মুখে।

অবসরে গেলেও তার সম্মান আর মর্যাদা সেই আগের মতোই। কঠিন অংকের সহজ সমাধান করে দিয়ে শিক্ষার্থীদের মন জয় করেছেন। তাইতো এখনও সেই শিক্ষার্থীদের চোখে-মুখে সম্মান আর ভালোবাসা রয়েছে নজরুল স্যারের প্রতি। তার কাছে লেখাপড়া করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়েছে অনেক শিক্ষার্থী।  

জনপ্রিয় শিক্ষক নজরুল ইসলাম ১৯৭৭ সালে খুলনার খালিশপুর গার্লস স্কুলে ২০০ টাকা বেতনে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরে খালিশপুর টিএন্ডটিতে চাকরি শুরু করেন তিনি। তবে সেখানে বেশিদিন থাকেননি তিনি। পেশার টানে ফের শিক্ষকতায় ফিরে আসেন। ১৯৮২ সালে যুক্ত হন খুলনার বিকে ইউনিয়ন ইনস্টিটিউটে। ২০১৩ সালে সেই স্কুল থেকেই অবসর নেন তিনি। এই সময়ে তিনি পেশাগত সুনাম অর্জন করেন। এখন তিনি পড়াচ্ছেন নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের।

খুলনা বিকে স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক মো. নজরুল ইসলাম বাবলু ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিক্ষকতার কারণে মানুষের অনেক সম্মান ও ভালোবাসা পেয়েছি। রয়েছে সুখস্মৃতিও। শিক্ষার্থীরা এখনও দেখা হলে শ্রদ্ধাভরে কাছে টেনে নেয়, সম্মান করে। আমার কাছে লেখাপড়া করা বহু ছেলে-মেয়ে এখন ভালো অবস্থানে রয়েছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, সরকারি উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাও হয়েছেন। অনেকেই এখনও আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। এটা আমাকে আনন্দ দেয়। এই অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না।

শিক্ষকতা পেশার শুরুর স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, খালিশপুর গার্লস স্কুলের দশম শ্রেণিতে প্রথম দিন গণিত ক্লাস নিচ্ছিলাম। ক্লাস নিতে নিতে হঠাৎ তাকিয়ে দেখি শিক্ষার্থীদের পেছনে বেঞ্চে ২/৩ জন শিক্ষকও বসে মনোযোগ দিয়ে ক্লাস উপভোগ করছে। তখন কেমন যেন অনুভূতি ছিল। তবে পরবর্তীতে দেখলাম সবাই ক্লাস উপভোগ করছে। সবাই পজিটিভভাবে আমাকে নিয়েছে। তখন ভালো লাগছিল।

নতুন প্রজন্মের শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে নজরুল ইসলাম বলেন, পুঁথিগত বা গাইড বই থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। অংক বুঝতে হবে, নোটের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। কঠিন অংক সহজভাবে শিক্ষার্থীদের মাঝে উপস্থাপন করতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকতে হবে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিসিপ্লিনের সহকারী অধ্যাপক মো. শামীম গাজী বলেন, নজরুল স্যার যেমন লেখাপড়ায় যেমন কঠোর ছিলেন, ক্লাসে তেমনই আন্তরিক ও পাঠদানকে প্রাণবন্ত করতেন। স্যারের ক্লাসে শিক্ষার্থীরা উৎসাহ পেতেন। তার ক্লাস করলে শিক্ষার্থীদের আলাদা অংক করার প্রয়োজন হতো না।

তিনি বলেন, বিকে ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশনে ৮ম শ্রেণিতে পড়াকালে প্রথম নজরুল স্যারের ক্লাস পাই। ৩ বছর স্যারের ক্লাস পেয়েছি। কঠিন অংকগুলো স্যার খুব সহজে বুঝিয়ে দিতেন। যে কারণে অংক সহজ মনে হতো। খুলনা জিলা স্কুল, করোনেশন, সেন্ট জোসেফ ও বি কে স্কুলের অসংখ্য শিক্ষার্থী নজরুল স্যারের কাছ থেকে অংক শিখেছেন। খুলনার মানুষ গণিত শিক্ষক হিসেবে স্যারকে এক নামে চেনেন।

বেনি বাবু রোডের বাসিন্দা মো. আনিস উদ্দিন বলেন, নজরুল স্যার খুলনায় গণিত শিক্ষাদানে অনন্য এবং অদ্বিতীয়। আমার দুই ভাতিজা, এক ভাতিজি ও আমার সন্তানসহ আমাদের পরিবারের অনেকেরই সৌভাগ্য হয়েছে নজরুল স্যারের কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণের। আমার দুই ভাতিজা তার কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর শিক্ষা শেষে একজন বর্তমানে ফিনল্যান্ড এবং অন্যজন ডেনমার্কে কর্মজীবন কাটাচ্ছেন। আমার নিজের সন্তানও তার কাছে শিক্ষা গ্রহণ করে এখন কোরিয়াতে রয়েছেন। নজরুল স্যারের এই অনবদ্য শিক্ষা তাদেরকে নিজ নিজ জীবনের সাফল্যের উচ্চ শিখরে যেতে সহযোগিতা করেছে। আমি খুলনার মানুষ হয়ে নজরুল স্যারকে নিয়ে গর্বিত।  

বিকে স্কুলের সাবেক কর্মচারী মো. গোলাম রব্বানী বলেন, নজরুল স্যারকে দেখতে কঠিন মনে হলেও তিনি অত্যন্ত রসিক। এক কথায় বলা যায় তিনি ‘রসিক রাগি’ ছিল। আমার দুই ছেলেও তার কাছে পড়েছেন। দুইজনই ভালো অবস্থানে রয়েছে। স্যারের প্রতিভা ও পাঠদানের কৌশল একেবারেই আলাদা। তার নীতি আদর্শ এখনও অমলীন। সবাই স্যারকে এক নামে চেনেন।

গণিত শিক্ষক নজরুল ইসলাম ১৯৬৮ সালে খুলনার সেন্ট জোসেফ স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭০ সালে বিএল কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ১৯৭৬—১৯৭৭ শিক্ষাবর্ষে খুলনা টিচার্স ট্রেনিং সেন্টার থেকে বিএড পাস করেন। তিনি ১৯৫১ সালের ১৭ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছেন। ছেলে স্থাপত্য বিভাগে এবং মেয়ে ব্যাংকে কর্মরত আছেন। তিনি খুলনা মহানগরীর মিয়াপাড়া কেন্দ্রীয় মসজিদ রোডে বসবাস করেন।

এমএএস