করোনার মধ্যেও বিরতিহীন গবেষণা চলছে বিনায়
পারমাণবিক কৌশল কাজে লাগিয়ে কৃষিখাতে অবদান রাখার একমাত্র প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা)। ফসলের নতুন জাত উদ্ভাবন, উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নতুন কলাকৌশল উদ্ভাবনসহ ফসলের রোগ ও পোকামাকড় ব্যবস্থাপনা হচ্ছে এই প্রতিষ্ঠানের গবেষণার মূল বিষয়।
এ কার্যক্রমকে গতিশীল রাখতেই করোনা পরিস্থিতি ও বিধিনিষেধেও বিরামহীন গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন বিনার বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়েই চলমান রেখেছেন তাদের কাজ।
বিজ্ঞাপন
বিনার ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোসা. সিফাতে রাব্বানা খানম। মাঠে ও ল্যাবে খরা ও লবণসহিষ্ণু ধানের উন্নত জাত উদ্ভাবনে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। স্বামী-সন্তান ও সংসার সামলিয়ে একদিনও থেমে থাকেনি তার গবেষণার কাজ।
বিজ্ঞাপন
ড. মোসা. সিফাতে রাব্বানা খানম বলেন, দেশ ও জাতির কাছে দায়বদ্ধতা থেকে ঝুঁকি নিয়েই গবেষণা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। এই ঝুঁকির মাঝেও আনন্দ আছে, সেটি হচ্ছে নতুন কিছু একটা সৃষ্টির আনন্দ। দেশ-জাতি ও বিশেষ করে কৃষকের জন্য নতুন কিছু উদ্ভাবনের চিন্তা করে আমরা আনন্দ নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি।
শুধু ড. সিফাতে রাব্বানা খানমই নন, বিনার সকল বিজ্ঞানীই কৃষির উন্নয়নে গবেষণা কাজ অব্যাহত রেখেছেন। আরেক ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সৈকত হোসেন ভুইয়া বলেন, দেশের কৃষির সার্বিক উন্নয়নের জন্য আমরা আসলে দায়বদ্ধ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দিয়েছেন, সে বিষয়টি মাথায় রেখেই আমরা দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। করোনার সাময়িক ঝুঁকি থাকলেও মাননীয় মন্ত্রী ও ডিজি মহোদয়ের প্রচেষ্টায় আমরা মোটামুটি ঝুঁকিমুক্তভাবেই কাজ করছি এবং সম্পূর্ণ কর্মস্পৃহা এই করোনাকালেও কাজে লাগাতে পারছি।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করে কৃষি ক্ষেত্রে সারাদেশে ব্যাপক সাফল্য এনে দিচ্ছে বিনা। এ পর্যন্ত ১৮টি ফসলের ১১২টি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছেন প্রতিষ্ঠানটির গবেষকরা। কারোনাকালীন দেড় বছরে সাতটি জাত উদ্ভাবনের কথা জানিয়েছেন তারা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, গবেষণা কাজে বিরতি দিলে পুনরায় সেই গবেষণা কাজ নতুন করে শুরু করতে হয়। তাই ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থেই করোনা ঝুঁকি সত্ত্বেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিচালিত হচ্ছে তাদের গবেষণা।
প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শামছুন্নাহার বেগম বলেন, অমরা চাই দেশকে এগিয়ে নিতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে কৃষকদের যাতে না খেয়ে থাকতে না হয় সেলক্ষ্যে আমরা করোনাকালেও গবেষণা কাজ করে যাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, গবেষণা কাজ বন্ধ থাকলে দেশে খাদ্যের যোগান দেওয়া সম্ভব হবে না এবং খাদ্য ঘাটতি দেখা দেবে। তাই চলমান গবেষণা কাজ বন্ধ রাখার সুযোগ নেই।
আরেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ড. মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, বিনা হচ্ছে একটি কৃষিভিত্তিক গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান। এর একটি অন্যতম শাখা হলো উদ্যানতত্ত্ব বিভাগ। এখানে টিস্যু কালচার ল্যাবের মাধ্যমে উদ্যানতাত্ত্বিক ফসলের জাত নিয়ে গবেষণা করা হয়। এখানে একসঙ্গে অনেকগুলো গবেষণা চলমান আছে।
তিনি আরও বলেন, এই ল্যাবে যে সমস্ত পরীক্ষণ স্থাপন করা হয়েছে এগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হয়। এই গবেষণা কাজ যদি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ না করা হয় তাহলে অনেক অর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে। সেইসঙ্গে নতুন জাত উদ্ভাবন থেকে পিছিয়ে পড়তে হবে। সেজন্য করোনাকালেও আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে ল্যাবের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি, যাতে আমাদের ক্ষতির সম্মুখীন না হতে হয়।
ল্যাবে গবেষণার পাশাপাশি বিনার পক্ষ থেকে নিয়মিত মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের কৃষি কাজে সহযোগিতাও করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিনার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং কৃষিতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মো. শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, কৃষিতত্ত্ব বিভাগ থেকে উদ্ভাবিত জাতগুলো কৃষকের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। করোনাকালীন আউশ মৌসুমে খরা সহিষ্ণু বিনা ধান-১৯ ও বিনা ধান-২১ কৃষকের মাঝে ৩৩ টন বীজ আমরা বিতরণ করেছি। আমনেও আমরা ৭০ টন বীজ বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছি।
‘কৃষি কাজ বন্ধ করা যাবে না’- প্রধানমন্ত্রীর এমন নির্দেশনা মেনেই করোনার সময়ে বিজ্ঞানীরা একদিনের জন্যও গবেষণা কাজ বন্ধ রাখেনি বলে দাবি করে বিনার মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, এই করোনাকালে স্বাস্থ্যখাত যেমন তাদের কাজ বন্ধ রাখেনি তেমনি আমরাও কৃষির কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা এই গবেষণা কাজ একদিনের জন্যও বন্ধ রাখিনি। কারণ একে সচল রাখতে হবে।
বিনার মহাপরিচালক আরও বলেন, মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী করোনার অধিক ঝুঁকি উপেক্ষা করে আমরা কৃষকের পাশেই আছি এবং আমাদের গবেষণা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।
ময়মনসিংহস্থ বিনার প্রধান কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত বিনার বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত ১৮টি ফসলের ১১২টি উন্নত জাতের মধ্যে রয়েছে- ধানের ২৪টি জাত, গমের একটি, সরিষার ৩০টি, ডাল ও বাদামের ৩২টি, পাটের দুটি, সবজির ১৪টি, মরিচের পাঁচটি ও লেবুর একটি জাত। করোনাকালীন উদ্ভাবন হয়েছে ধান, মশুর ডাল, সরিষাসহ সাতটি উন্নত নতুন জাত।
করোনাভাইরাসে বিনার দুইজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মৃত্যু ও ১৫ জন বিজ্ঞানী আক্রান্ত হলেও কৃষি ও কৃষকের কথা চিন্তা করে নিয়মিত গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন প্রধান কার্যালয়সহ ১৩টি উপকেন্দ্রের ১৭০ জন বিজ্ঞানী।
এসপি