১১ সন্তানের মা অরিফন নেছা। একে একে জন্ম দিয়েছেন ৫ মেয়ে ও ৬ ছেলের। তবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, তার একটি সন্তানও বেঁচে নেই। সন্তানদের হারানোর পাহাড়সম শোকের ভার নিয়েই জীবন পার করছেন তিনি। জীবনের শেষ বয়সে এসে হয়েছেন বিধবা। স্বামী ও সন্তানহারা এই বৃদ্ধার এখন জীবন চলে ভিক্ষা করে।

অরিফন নেছা টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার কাকড়াজান ইউনিয়নের হাড়িঙ্গাচালা গ্রামের মৃত হায়েত আলীর স্ত্রী। তিনি দুই বছর আগে বিধবা হয়েছেন। বেঁচে নেই মা-বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ি। আত্মীয়-স্বজন বলতেও কেউ নেই তার পাশে।

জানা যায়, প্রতিবেশীদের দেওয়া খাবার খেয়েই তিনি বেঁচে থাকেন, আর খাবার না জুটলে থাকেন অনাহারে। ৭৯ বছর বয়সী অরিফন নেছার শেষ বয়সের দিনগুলো কষ্টে কাটছে। অর্থের অভাবে চিকিৎসাও নিতে পারছেন না তিনি। মানুষের সাহায্য নিয়ে যেটুকু পান, তা দিয়েই জীবন চলে তার।

দাম্পত্য জীবনে ৫ মেয়ে ও ৬ ছেলে মোট ১১ জন সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন অরিফন নেছা। কিন্তু সবাই জন্মের পর মারা গেছেন। স্বামী জীবিত থাকা অবস্থায় দু’জন মিলে অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতেন। স্বামীর মৃত্যুর আগে তিনি স্ত্রীর জন্য কোনো নিরাপদ আশ্রয় রেখে যেতে পারেননি। এখন দুই শতাংশ জমির এক ছোট, জীর্ণ-শীর্ণ ঘরে একাকী থাকেন বৃদ্ধা। সেখানে টিউবওয়েল, বিদ্যুৎ বা শৌচাগার নেই। বয়স বৃদ্ধির কারণে কাজও করতে পারেন না, তাই অন্যের বাড়িতে ভিক্ষা করে জীবন চালান। শেষ বয়সে নানা রকম অসুখও দেখা দিয়েছে তার।

অরিফন নেছা বলেন, পাঁচ মেয়ে আর ছয় ছেলে জন্ম দিয়েছিলাম, কেউ বেঁচে নেই। আমি একাই এই পৃথিবীতে রয়ে গেছি। আমার আর কেউ নেই। এখন ভিক্ষা করে খাবার জোগাড় করি। আমার কোনো সন্তান নেই, আমি কী করে চলব? আল্লাহ আমাকে দয়া কর।

তিনি আরও বলেন, আমার বাড়ি, টিউবওয়েল, টয়লেট বা বিদ্যুৎ নেই। যদি ১১ সন্তান বেঁচে থাকত, আমার এই অবস্থা হতো না। দুই বছর আগে স্বামী মারা গেছে। শেষ বয়সে অসুস্থ অবস্থায় মানুষের কাছে চেয়ে জীবন চলে। হাঁটতেও পারি না, কোমরের হাঁড় ক্ষয় হয়েছে। মাছ-মাংস খেতে চাই, কিন্তু টাকার অভাবে পারি না। মানুষের বাড়িতে গেলে মাংসের তরকারি চেয়ে খেতে হয়।

অরিফন নেছা বলেন, আমার নিজস্ব জমিজমা নেই। মরলে আমাকে কোথায় রাখা হবে জানি না। শেষ বয়সে শান্তিতে মরতে চাই। কখনো সুখ পাইনি, জীবনটা মানুষের বাড়িতে কাজ করে কাটিয়েছি। স্বামী থাকলেও সুখ পাইনি, এখন তো আর কথা নেই।

স্থানীয় বাসিন্দা মমতা বেগম বলেন, নেত্রকোনা থেকে এসে তার স্বামী তাকে বিয়ে করেছিলেন। ১১ সন্তান জন্ম দিলেও কেউ বেঁচে নেই। স্বামীও মারা গেছেন। অরিফন নেছা মানুষের বাড়িতে চেয়ে খায়। তার জমিজমা কিছু নেই। যেখানে থাকে, অন্য একজন জমিটি দিয়েছিলেন। ঘরে পানি পড়ে। এমন অসহায় মানুষ এলাকার মধ্যে আর নেই। যদি দুই-তিন সন্তান বেঁচে থাকত, তবে তার এত কষ্ট পেতো না।

অন্য এক স্থানীয় জাকির হোসেন বলেন, তার খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বাসস্থানের কোনো ব্যবস্থা নেই। তিনি গ্রামের একেবারে অসহায় মানুষ। ১১ সন্তান মারা যাওয়ায় তার অবস্থা এমন হয়েছে। তার পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই।

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মনসুর আহমেদ বলেন, অরিফন নেছার ১১ সন্তানের সবাই মারা গেছেন এবং স্বামীও নেই, বিষয়টি আমরা নিশ্চিত হয়েছি। তবে তাকে বয়স্ক ভাতার আওতায় আনতে পেরেছি। তিনি সমাজের অবহেলিত একজন মানুষ হিসেবে আমাদের তালিকায় আছেন। আমরা তার পাশে দাঁড়াচ্ছি। তবে সরকারের একার পক্ষে তাকে সচ্ছল করা সম্ভব নয়, তাই সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতা কামনা করছি।

আরিফুল ইসলাম/এআরবি