শুধু বইয়ের জ্ঞান নয়, যিনি শিখিয়েছেন জীবনের মূল্যবোধ
শিক্ষক গাজী মোহাম্মদ আলী। ছবি: ঢাকা পোস্ট
যার হাতে গড়া হাজারো শিক্ষার্থীর আলোয় ঝলমল করছে দেশ ও বিদেশ। প্রতিটি শিশুর ভেতরের সম্ভাবনাকে মুক্ত করে, জ্ঞান ও মূল্যবোধের ভিত্তিকে মজবুত করে যে মানুষটি নীরবে দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলেন, তিনিই শিক্ষক। এমনই এক মহৎ মানুষ গাজী মোহাম্মদ আলী। যিনি বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার প্রান্তিক অঞ্চলে অবস্থিত ২১ চাকশ্রী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন।
শিক্ষকতা জীবনে তিনি কাটিয়েছেন ৩৮টি বসন্ত। এই সুদীর্ঘ সময়ে তার হাত ধরে শিক্ষা নিয়েছেন হাজার হাজার শিক্ষার্থী। যারা আজ দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে, এমনকি বিদেশেও নিজেদের দক্ষতা প্রমাণ করছেন। শুধু একজন শিক্ষক নন, তিনি ছিলেন অভিভাবক, বন্ধু এবং এক প্রকৃত পথপ্রদর্শক।
বিজ্ঞাপন
বানতলা ইউনিয়নের বারুইপাড়া গ্রামের সন্তান গাজী মোহাম্মদ আলী। তিনি ১৯৬৬ সালে গাজী আদিল উদ্দিন এবং জবেদা বেগমের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষকতার জীবন শুরু হয় ১৯৮৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর, মল্লিকের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে। এরপর বিভিন্ন সময়ে তিনি দুর্গাপুর, পশ্চিম গোবিন্দপুর, গোবিন্দপুর, ফয়লার হাটসহ আরও কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করেন।
বিজ্ঞাপন
১৯৯৩ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ফয়লার হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, এরপর আবার গোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। দীর্ঘ চেষ্টার ফলস্বরূপ ২০০০ সালে তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করে প্রথমে প্রসাদ নগর ভৈরবডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যুক্ত হন। অবশেষে ২০০১ সালে যোগ দেন ২১নং চাকশ্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠানটিকে নিজের জীবনের অংশ করে নিয়েছেন।
আগামী ডিসেম্বরের ২৪ তারিখ দীর্ঘ ৩৮ বছরের শিক্ষকতা জীবন থেকে অবসর নেবেন এই মহান শিক্ষক। ইতোমধ্যে তিনি ২ শতাধিকের বেশি নানা বিষয়ে স্বীকৃতি অর্জন করেছেন, যা তার পেশার প্রতি গভীর নিষ্ঠা ও ভালোবাসার প্রমাণ।
ময়মনসিংহ মেডিকেল আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. নাইমা আফরোজ শিমু বলেন, স্যার শুধু বইয়ের জ্ঞান দেননি, শিখিয়েছেন জীবনের মূল্যবোধ। তার উৎসাহ ছাড়া হয়তো ডাক্তার হওয়াটা এতটা সহজ হতো না।
আরও পড়ুন
চাকশ্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক ফাতেমাতুল জোহরা বলেন, স্যার একজন অভিভাবক। তার কাছ থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। এত বছর ধরে তার নিষ্ঠা আমাদের অনুপ্রাণিত করে। তার স্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেছি এখন আমি তার সঙ্গে শিক্ষকতা করছি। পৃথিবীর সব থেকে ভাগ্যবান ব্যক্তি আমি
পয়লা হাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শেখ শরিফুল ইসলাম বলেন, স্যার আমাদের শুধু শিক্ষক নন, তিনি একজন প্রতিষ্ঠান। প্রান্তিক পর্যায় থেকে এতগুলো কৃতী ছাত্র-ছাত্রী তৈরি করা সত্যিই শিক্ষাজীবনের এক বিশাল অর্জন।
লন্ডনে ব্যারিস্টারের শিক্ষার্থী শেখ আবুল বাশার বলেন, আজ আমি লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়ছি। এর ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক গাজী মোহাম্মদ আলী স্যার। তার শিক্ষা আমার জীবনের প্রতিটি ধাপে পথ দেখিয়েছে।
শিক্ষকতা জীবন নিয়ে প্রধান শিক্ষক গাজী মোহাম্মদ আলী বলেন, আমার মূল লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য ছিল একজন মানুষ তৈরি করা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রধান ভিত্তি হলো প্রাইমারি লেভেল। সেখান থেকে যদি তাদের ভালো করে গড়ে তোলা যায়, তাহলে আমাদের দেশটাকে আলোকিত করতে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে না। আমরা শিক্ষকরা চাইলেই এই পৃথিবীটাকে আলোকিত করে তুলতে পারি। দীর্ঘ ৩৮ বছরে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে নিজের সন্তানের মতো গড়ে তুলেছি। নিজের সন্তান আর শিক্ষার্থীদের কখনো আলাদা করে দেখিনি।
তিনি বলেন, খুবই ভালো লাগে যখন কোনো দপ্তরে বা অফিসে গেলে অফিসের প্রধানকে দেখতে পাই আমার শিক্ষার্থীকে। মনটা ভরে যায়, তখনই নিজের সার্থকতা বুঝতে পারি। আমার কোনো শিক্ষার্থী বুয়েট, কুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করছে, অনেকে দেশের বাইরে বিভিন্ন দপ্তরের প্রধান হিসেবে কাজ করছে। দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমার শিক্ষার্থীরা রয়েছে এটাই আমার সার্থকতা।
গাজী মোহাম্মদ আলীর অক্লান্ত পরিশ্রম আর ভালোবাসার ফল আজ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তার হাত ধরে শিক্ষা গ্রহণ করে আজ দেশের নামিদামি বুয়েট, কুয়েটসহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন প্রায় দুই শতাধিক প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী। এ ছাড়া, তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে উঠে আসা মেধাবীরা সমাজের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন।
গাজী মোহাম্মদ আলীর এই পথচলা কেবল একটি শিক্ষকের গল্প নয়, এ হলো ত্যাগ, নিষ্ঠা আর ভালোবাসার এক অবিস্মরণীয় উপাখ্যান, যা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে পথ দেখিয়ে চলেছে।
এএমকে