জন্ম থেকে দুই হাত নেই জসীমের, কাঁচামাল বিক্রি করে চলছে লেখাপড়া
জন্ম থেকে দুই হাত নেই জসীম মাতুব্বরের (২৬)। পা দিয়ে লিখে পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি এবং এইচএসসি পাস করেছেন। বর্তমানে সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তিনি। ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার তালমা ইউনিয়নের কদমতলী গ্রামের হানিফ মাতুব্বর ও তসিরন বেগম দম্পতির চার ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে সবার বড় জসীম।
অভাবের সংসারে কৃষক বাবার আয়ে সংসার চলে না। এজন্য পড়াশোনার পাশাপাশি শৈশব থেকে কাজের দিকে নজর দেন জসীম। কখনো বাঙ্গি, কখনো তরমুজ বিক্রি করে আয়ের পথে পা বাড়ান জসীম। বর্তমানে তিনি তালমার রসুলপুর বাজারে কাঁচামাল বিক্রি করেন। এ দিয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ, হাত খরচ চালিয়ে বাবার হাতে তুলে দেন সংসারের যোগান বাবদ টাকা।
বিজ্ঞাপন
জসীম মাতুব্বর ২০১৩ সালে কদমতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পিএসসি পাস করেন। ২০১৬ সালে তালমা নাজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জেএসসি এবং ২০১৯ সালে এসএসসি পাস করেন। ২০২৩ সালে ফরিদপুর সিটি কলেজ থেকে ৪.২৯ (এ গ্রেড) পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন।
সম্প্রতি জসীম মাতুব্বর আলোচনায় আসেন এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) কার্ড করা নিয়ে। দুই হাত না থাকায় আঙুলের ছাপ দিতে না পারার কারণে ২০২৩ সাল থেকে নির্বাচন কার্যালয়ে বারবার ধরণা দিয়েও তিনি এনআইডি কার্ড করতে পারেননি।
বিজ্ঞাপন
এ সংক্রান্ত খবর বিভিন্ন মিডিয়ায় আসার পর বিষয়টি নজরে আসে নগরকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দবির উদ্দিনের। তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে জসীমের আবেদনপত্রের সঙ্গে নিজের সুপারিশপত্র নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে মাত্র ১১ দিনের ব্যবধানে জসীমের এনআইডি কার্ড প্রস্তুত হয়ে যায় গত ৫ অক্টোবর।
এতদিন জাতীয় পরিচয়পত্র না পাওয়ায় বিভিন্ন কাজকর্ম ও সরকারি-বেসরকারি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলেন তিনি। জসীমের দীর্ঘদিনের আশা পূরণ করতে পেরে নিজেও খুশি ইউএনও দবিউদ্দিন।
তিনি বলেন, মিডিয়ার মাধ্যমেই জসীমের সমস্যার কথাটি আমি প্রথম জানতে পারি। ওর কাহিনি পড়ে আমি খুবই অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। দুই হাত না থাকা সত্ত্বেও সে নিজের যোগ্যতায় এসএসসি, এইচএসসি পাস করেছে। এখন ডিগ্রি শ্রেণিতে পড়ছে। তার মতো একজন মেধাবী তরুণ শুধু এনআইডি না থাকার কারণে যেন পিছিয়ে না পড়ে, সেটিই নিশ্চিত করতে চেয়েছি। এ কাজটি আমি সম্পাদন করতে পেরেছি। এ ঘটনাটি সারাজীবন আমার জীবনে স্মৃতি হয়ে থাকবে। আমি দেশের যে স্থানেই কাজ করি না কেন, সব জায়গায় মানুষের কাছে অদম্য জসীমের গল্প বলে বেড়াব।
গত ২১ অক্টোবর দুপুরে নগরকান্দার রসুলপুর বাজারে গিয়ে দেখা যায়, আলু, পটল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, শসা,বেগুনসহ বিভিন্ন কাঁচামাল বিক্রি করছেন জসীম। তার দোকানে ক্রেতাদের ভিড়। পা দিয়ে পণ্য মেপে, তা ব্যাগে ভরে, খুচরা টাকা ফেরত দিয়ে টাকা গুনে নিতে ব্যস্ত সময় পার করছে সে। কোনো দিকে মন দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই তার।
জসীমের দোকান থেকে পণ্য কেনার পর তালমা গ্রামের বাসিন্দা শেখ হাফেজ সরদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, জসীম খুব ভালো ছেলে। ব্যবসার পাশাপাশি লেখাপড়া করে। ব্যবহার ভালো। এলাকার সবাই তাকে ভালোবাসে। আমরা ভিড় করে তার কাছ থেকে কাঁচামাল কিনি।
তালমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল হোসেন মিয়া বলেন, জসীম আমাদের এলাকার এক বিস্ময় তরুণ। তার সংগ্রামী জীবনের গল্প এলাকার মানুষের মুখে মুখে। যে ছেলের মধ্যে এত প্রাণশক্তি রয়েছে, সেই ছেলেকে কোনো প্রতিবন্ধকতা দমিয়ে রাখতে পারে না।
সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্র জসীমের ব্যাপারে খোঁজখবর রাখেন অধ্যক্ষ এস. এম. আব্দুল হালিম। জসীমের সাফল্য কামনা করে তিনি বলেন, অভাবের সংসারের একটি ছেলে, জন্ম থেকে যার দুটি হাত নেই, সে এখন আমার কলেজের স্নাতক (ডিগ্রি ২য় বর্ষ) শ্রেণির শিক্ষার্থী। জসীম আমাদের সমাজে একটি উদাহরণ হতে পারে—একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। দুই হাত না থাকার পরও যে ছেলে পা দিয়ে লিখে স্নাতক শ্রেণি পর্যন্ত আসতে পারে, তার অদম্য এই গতি তাকে সাফল্যের চূড়ায় নিয়ে যাবে—এটাই আমার প্রত্যাশা।
শারীরিক জটিলতাকে জয় করে সামনের দিকে আরও এগিয়ে যেতে চান জসীম মাতুব্বর।
জসীম জানায়, অভাবের সংসারে দিনের বেলা বিভিন্ন হাটে সবজি বিক্রি করে যে আয় করেন, তা দিয়ে নিজের পড়াশোনাসহ খরচ নির্বাহ করে থাকেন। তবে লেখাপড়ার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ কোনো বাধা তাকে রুখতে পারেনি।
জসীম মাতুব্বর বলেন, আগে সবার সঙ্গে মিশতে পারতাম না। মানুষ আমাকে হেয় করত। তবে পড়াশোনা করছি, পরীক্ষা দিচ্ছি, ভালোভাবে পাস করছি— যার কারণে এখন মানুষ সম্মান করে। বন্ধুরা আমাকে ভালোবাসে।
পড়াশোনা শেষ করে কী হতে চান জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার যোগ্যতা অনুযায়ী যে কোনো একটি সরকারি চাকরি করতে চাই।
আরএআর