ফাঁকা পড়ে থাকে ফুটওভার ব্রিজ, ডিভাইডারের গ্রিল ভেঙে মহাসড়ক পারাপার
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দেশের অন্যতম ব্যস্ত মহাসড়ক। এই মহাসড়কের বেশিরভাগ অংশই কুমিল্লায় পড়েছে। ব্যস্ত এই মহাসড়কে রাস্তা পারাপারের জন্য প্রতিটি বাস স্টেশনের পাশেই নির্মাণ করা হয়েছে ফুটওভার ব্রিজ। কিন্তু সেসব ফুটওভার ব্রিজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দ্রুত গতির বাস এবং অন্যান্য যানবাহনের সামনে দিয়েই মহাসড়ক পারাপার হন পথচারীরা। এতে বাড়ছে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির সংখ্যা।
শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত, চাকরিজীবী বা বেকার কেউই মহাসড়কে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করেন না। মৃত্যু ঝুঁকি জেনেও মহাসড়কের মাঝ দিয়েই একপাশ থেকে অপর পাশে যান পথচারীরা। এতে প্রায়ই ঘটছে ভয়াবহ দুর্ঘটনা, প্রাণ হারাচ্ছেন মানুষ, কেউ বা চিরতরে হচ্ছেন পঙ্গু।
বিজ্ঞাপন
কুমিল্লা সড়ক বিভাগ বলছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা অংশের ১০৫ কিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন ব্যস্ত এলাকায় ৫৪টি ফুটওভার ব্রিজ রয়েছে। প্রতিটি ব্রিজ নির্মাণে সরকারের কোটি টাকার কাছাকাছি খরচ হয়েছে। কিন্তু মানুষ সেসব ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করে জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়ে চলাচল করছে মহাসড়কে।
হাইওয়ে পুলিশের তথ্যমতে, গত ৯ মাসে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ৪৬৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে নিহত হয়েছেন ২৮৪ জন। পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন ৫০৯ জন। রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ির চাপায় প্রাণ গেছে অনেকের।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে দেখা গেছে, কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার ইলিয়টগঞ্জ বাস স্টোপেজেই রয়েছে একটি ফুটওভার ব্রিজ। কোটি টাকা ব্যয়ে ফুটওভার ব্রিজটি নির্মাণ করে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর। কিন্তু এই ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে একজনকেও পারাপার হতে দেখা যায়নি। শিশু থেকে, বৃদ্ধ, যুবক এমনকি সব বয়সের নারী-পুরুষ ফুটওভার ব্রিজটির ঠিক নীচ বরাবর সড়কের ওপর দিয়েই পারাপার হচ্ছেন। আইন অমান্য করে মহাসড়কের মাঝের ডিভাইডারের লোহার গ্রিল ভেঙে পথ করা হয়েছে এপাশ থেকে অপর পাশে যাওয়ার জন্য।
শুধু ইলিয়টগঞ্জই নয়। মহাসড়কের প্রায় প্রতিটি ফুটওভার ব্রিজের একই চিত্র। ব্রিজ পড়ে আছে অসহায়ের মতো। মানুষজন পারাপার হচ্ছেন সড়কের ঠিক মাঝ দিয়ে।
জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়ে সড়ক পারাপার করা এসব মানুষদের কেউ অসুস্থতার অজুহাতে, কেউ সময় বাঁচাতে, কেউ আবার অভ্যাস থেকেই দ্রুতগতির গাড়ির সামনেই সড়কে পার হতে দেখা গেছে।
আহমেদ সুমন নামের এক ব্যাংক কর্মকর্তা সড়কের ওপর দিয়েই পার হয়ে একপাশ থেকে অন্যপাশে এলেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আসলে আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে এটা। আপনি দেখেন- দলে দলে মানুষ সড়কের ওপর দিয়েই পার হচ্ছেন। সেসব মানুষের সঙ্গেই চলে এসেছি। ফুটওভার ব্রিজ আমাদের ভালোর জন্যই করা হয়েছে। আমরা সেটি ব্যবহার করছি না। সময় বাঁচাতে গিয়ে এমনটা হচ্ছে। এটা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
তানভীর হোসেন নামের এক কলেজছাত্র ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফুটওভার ব্রিজে ওঠানামা করা অনেক কষ্টের। তাই ঝুঁকি নিয়েই সড়ক পারাপার হই।
আবু ইউসুফ নামের এক পথচারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা সবসময় সড়কের ওপর দিয়ে যেতে যেতে অভ্যাস হয়ে গেছে। তবে এভাবে যাওয়া-আসা ঠিক না।
ইলিয়টগঞ্জ ফুটওভার ব্রিজের নীচে স্থানীয় সেলুন ব্যবসায়ী নয়ন মিয়া। অনেক দুর্ঘটনার সাক্ষী তিনি। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, চোখের সামনে অনেক দুর্ঘটনা দেখেছি। মানুষ রাস্তা পার হচ্ছেন এমন সময় দ্রুত গতির একটি কাভার্ডভ্যান বা বাস এসে তুলে দিল তার ওপর। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মারা গেছেন কিংবা পঙ্গু হয়ে গেছেন। মানুষ তবুও কেন জানি এত ঝুঁকি নিয়ে পার হয়।
সচেতন মহল বলছেন, মানুষকে একটি নিয়মের মধ্যে আনার চেষ্টা করতে হবে সব ক্ষেত্রে। এর জন্য প্রয়োজন সবার সদিচ্ছা। মানুষকে সচেতন করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার বৃদ্ধি পাবে মহাসড়কে।
কুমিল্লা কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ হুমায়ূন কবির মাসউদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, সম্ভবত আমরাই একমাত্র জাতি যারা মৃত্যুর তোয়াক্কা না করেই মহাসড়কে নিজেকে বিলিয়ে দেই। সড়ক পারাপারের জন্য সরকার ফুটওভার ব্রিজ করে দিয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে সড়ক পারাপার না হয়ে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
সচেতন নাগরিক কমিটি কুমিল্লার সাবেক সভাপতি শাহ আলমগীর খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার না করায় যেমন মানুষের অনীহা তেমনি প্রশাসনেরও উদাসীনতা রয়েছে। প্রশাসন প্রয়োজনে যারা ঝুঁকি নিয়ে পার হচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হোক। এভাবেই মানুষকে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে বাধ্য করতে হবে।
হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা রিজিয়নের পুলিশ সুপার মো. শাহিনুর আলম খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মহাসড়কে রাস্তা পারাপারে মানুষের সচেতন হতে হবে। এর বিকল্প কিছু নেই। পুলিশের হাতে যে ক্ষমতা রয়েছে আমরা সেটাকে ব্যবহার করে মানুষকে ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে পারাপারে উদ্বুদ্ধ করছি। কিন্তু পথ যারা ব্যবহার করেন প্রত্যেককে অবশ্যই সচেতন হতে হবে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কুমিল্লা নির্বাহী প্রকৌশলী খন্দকার গোলাম মোস্তফা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা ফুটওভার ব্রিজ তৈরি করে দিয়েছি। সড়কে চলাচলকারী সবার উচিত নিজ দায়িত্বে এটাকে ব্যবহার করা। মানুষকে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে সচেতন করতে আমরা সবসময় কাজ করে যাচ্ছি। আমরা মহাসড়কে মাঝখানে লোহার রড দিয়ে ঘেরাও করে দেই, মানুষ সেসব রড ভেঙে রাস্তার মাঝ দিয়ে চলাচল করে। আমরা আমাদের পক্ষে যেটা করণীয় সেটা করে যাচ্ছি, মানুষকে সচেতন হতে হবে।
আরকে