রংপুর কারমাইকেল কলেজ : ১০৯ বছরের গৌরবে উৎসবমুখর ক্যাম্পাস
উত্তরাঞ্চলের অক্সফোর্ডখ্যাত ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কারমাইকেল কলেজ আজ ১০৯ বছরে পদার্পণ করেছে। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যোগ্য নেতৃত্ব ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ গড়ার কারখানা হিসেবে খ্যাত শতবর্ষী এই বিদ্যাপীঠে আজ উৎসবের আমেজ বইছে।
উত্তরবঙ্গের শিক্ষা বিস্তারের কেন্দ্রবিন্দু এই শিক্ষাঙ্গনে বর্ষপূর্তি ও তারুণ্য মেলা উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছে দুই দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য উৎসব। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ঘিরে সাজসজ্জায় সেজেছে পুরো ক্যাম্পাস। আলোকসজ্জায় ঝলমল করছে ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলো, পরিচ্ছন্নতায় নব রূপে সেজেছে প্রাঙ্গণ।
বিজ্ঞাপন
গৌরবময় পথচলার ১০৯ বছরপূর্তি উৎসবের প্রথম দিন আজ সোমবার ছিল বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, স্মৃতিচারণ, কেককাটা ও মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সকাল ১০টায় জি.এল হোস্টেল মাঠে জাতীয় ও কলেজের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দিনব্যাপী আনুষ্ঠানিকতা। বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে উদ্বোধন করেন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. মুহম্মদ রেজাউল হক। শোভাযাত্রা শেষে প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং শুভানুধ্যায়ীরা অংশ নেন আলোচনা সভা, কেককাটা ও সাংস্কৃতিক আয়োজনে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. মোস্তাফিজুর রহমান।
বিশেষ অতিথি ছিলেন সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. আমজাদ হোসেন, সরকারি বেগম রোকেয়া কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. ইসমাইল হোসেন সরকার, সরকারি সিটি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. বোরহান উদ্দিন, কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর মো. হাবিবুর রহমান এবং শিক্ষক পরিষদের সম্পাদক প্রফেসর দিলীপ কুমার রায়।
বিজ্ঞাপন
উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক প্রফেসর ড. মো. সাইফুর রহমান বলেন, ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তানি শোষণ ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে কারমাইকেল কলেজ এক জীবন্ত সাক্ষী। এই প্রতিষ্ঠানের শতবছরের গৌরব ও অর্জন অনন্য। তিনি জানান, নবীন-প্রবীণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মিলনমেলায় মুখর হয়েছে পুরো ক্যাম্পাস। আগামীকাল মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) সমাপনী দিনে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশ পুলিশের রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি মো. আমিনুল ইসলাম, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. মজিদ আলীসহ আরও অনেকে।
কারমাইকেল কলেজের প্রতিষ্ঠা ইতিহাস :
১৯১৬ সালের ১০ নভেম্বর তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার গভর্নর লর্ড থমাস ডেভিড ব্যারন কারমাইকেল এই কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। তার নামেই কলেজের নামকরণ করা হয় কারমাইকেল কলেজ। ১৯১৭ সালের জুলাইয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এখানে আইএ ও বিএ ক্লাস খোলার অনুমতি দেয়। শুরুতে প্রায় দুই বছর রংপুর জেলা পরিষদ ভবনে ক্লাস পরিচালিত হয়। ১৯১৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করা হয় মূল ভবনের। জার্মান নাগরিক ড. ওয়াটকিন ছিলেন কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ।
রংপুরবাসীর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল একটি মানসম্মত কলেজ প্রতিষ্ঠা। ১৮৩২ সালে রংপুর জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠার পর শিক্ষায় আগ্রহ বেড়ে যায়, কিন্তু উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের যেতে হতো ভারতের কোচবিহারে। ১৯১৩ সালে গভর্নর ব্যারন কারমাইকেল রংপুরে আসলে সংবর্ধনা সভায় কলেজ স্থাপনের দাবি ওঠে। জমিদার ও শিক্ষানুরাগীদের অর্থসহ দান করা ৯০০ একর জমির ওপর গড়ে ওঠে এই বিদ্যাপীঠ।
রংপুর শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়-অধিভুক্ত কারমাইকেল কলেজে বর্তমানে ১৯টি বিভাগে প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছেন। অবিভক্ত বাংলার প্রথম সারির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি এই কলেজ ২০০১ ও ২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার দুটি আইন পাস হলেও তা আজও কার্যকর হয়নি।
নয়নাভিরাম ক্যাম্পাস ও স্থাপত্য :
সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশে অবস্থিত এই কলেজ জমিদারি স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন। ৬১০ ফুট লম্বা ও ৬০ ফুট প্রশস্ত ইন্দোস্যারানিক আদলে নির্মিত মূল ভবনের গম্বুজ ও কারুকাজ মোগল স্থাপত্যের স্মৃতি জাগায়। রংপুরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান হিসেবে এটি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়।
প্রবেশের পরেই বাম পাশে শিক্ষকদের আবাসিক ভবন ও ‘হোয়াইট হাউস’ নামে পরিচিত ডরমিটরি। পাশেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও কিউএ মেমোরিয়াল প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিপরীতে শতবর্ষী বিলুপ্তপ্রায় কাইজেলিয়া বৃক্ষ, যা আফ্রিকা থেকে আনা হয়েছিল। এই বৃক্ষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘কারমাইকেল কাইজেলিয়া শিক্ষা-সংস্কৃতি সংসদ (কাকাশিস)’। এরপর রয়েছে চৌরাস্তা বা জিরো পয়েন্ট।
ক্যাম্পাসজুড়ে রয়েছে শতবর্ষী ভবন, মসজিদ, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র, ছাত্রী বিশ্রামাগার, বিভিন্ন বিভাগীয় ভবন ও ক্যান্টিন। আবাসিক হলগুলোর মধ্যে রয়েছে তাপসী রাবেয়া হল, বেগম রোকেয়া হল, জাহানারা ইমাম হল, জি.এল., ওসমানী, সি.এম. ও কে.বি. হল। নতুন করে নির্মিত হয়েছে আরও একটি ছাত্রাবাস, তবে সি.এম. হলটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
এছাড়া রয়েছে সাব পোস্ট অফিস, আধুনিক অডিটোরিয়াম, বিএনসিসি ও স্কাউট ভবন, ছাত্র বিশ্রামাগার, পুলিশ ফাঁড়ি, প্রশাসন ভবন ও চারটি খেলার মাঠ। মূল ভবনের সামনে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ভাস্কর্য ‘প্রজন্ম’ নান্দনিকতায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। দক্ষিণে শহীদ মিনার, তিনতলা বিজ্ঞান ভবন, কলা ও বাণিজ্য ভবন, রসায়ন ভবন এবং ফুলে ঘেরা বাগান। প্রায় ৭০ হাজার বইয়ের সমৃদ্ধ লাইব্রেরিটি শুরু হয়েছিল মাত্র ২৫০টি বই নিয়ে। মূল ভবনের মাঝখানে রয়েছে ‘আনন্দমোহন হল’।
উত্তর-পশ্চিম কোণে ‘বাংলা মঞ্চ’ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। লিচুতলার সংস্কৃতি মঞ্চে নিয়মিত সৃজনশীল আয়োজন করেন শিক্ষার্থীরা। ক্যাম্পাসে রয়েছে স্পন্দন, কানাসাস, বিতর্ক পরিষদ, কাকাশিস, আবৃত্তি সংসদ, বাঁধন, বিএনসিসি, রোভার স্কাউটসহ নানা সাহিত্য-সংস্কৃতি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। বটতলায় নতুনভাবে গড়ে উঠেছে রবীন্দ্র-নজরুল মঞ্চ। চারপাশে রংপুর ক্যাডেট কলেজ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রেলস্টেশন ও ছাত্রাবাসে ঘেরা প্রাণচঞ্চল এই ক্যাম্পাস।
কৃতি শিক্ষার্থীদের গর্ব :
কারমাইকেল কলেজ শুধু শিক্ষার বাতিঘর নয়, এটি রাজনৈতিক চর্চারও এক ঐতিহ্যবাহী কেন্দ্র। লাখো শিক্ষার্থীর জীবনের সোনালি দিনের স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। এখান থেকে শিক্ষা নিয়েছেন অসংখ্য কৃতিমান ব্যক্তি- একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল আন্দোলনের নেত্রী জাহানারা ইমাম, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, সাবেক সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল মুস্তাফিজার রহমান, কথাসাহিত্যিক আনিসুল হকসহ অনেকেই।
এছাড়া এখানে পড়েছেন শহীদ ছাত্রনেতা রাউফুন বসুনীয়া, কবি ও সাংবাদিক আবদুল হাই শিকদার, সাবেক উপমন্ত্রী আসাদুল হাবিব দুলু, জাতীয় সংসদের প্রথম স্পিকার শাহ আব্দুল হামিদ, ছড়াকার রফিকুল হক এবং যুক্তরাজ্যের হিন্ডবার্ন সিটির সাবেক মেয়র আলতাফুর রহমান।
প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছিলেন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য এম আব্দুর রহিম, সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন, বাংলাদেশের প্রথম প্রধান বিচারপতি ও ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, স্বাধীনতা সংগ্রামী মণিকৃষ্ণ সেনসহ আরও অনেকে। ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলনে এই কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অবদান গর্বের অংশ হয়ে আছে ইতিহাসে।
৩৫ বছর ধরে নেই ছাত্র সংসদ :
কারমাইকেল কলেজে সর্বশেষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালে। এরপর থেকে আর কোনো নির্বাচন হয়নি। ফলে কাকসুর তহবিলে প্রায় ১ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও কারমাইকেল কলেজে তা হয়নি, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা তৈরি করেছে।
এই কলেজের শিক্ষার্থীরা স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তারা নেতৃত্ব, সমাজসেবা ও রাজনৈতিক সচেতনতা শিখেছেন। তবে ৩৫ বছর ধরে নির্বাচন না হওয়ায় নেতৃত্ব বিকাশ ও গণতান্ত্রিক চর্চা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন শিক্ষার্থীরা।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এআরবি