হাবিবুর রহমান হাবিব, শফি আহমদ চৌধুরী, আতিকুর রহমান আতিক ও জুনায়েদ মোহাম্মদ মিয়া (বাঁ থেকে)

সিলেট-৩ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিবের ঋণ বেশি। অন্যদিকে বিএনপি নেতা (বহিষ্কৃত) শফি আহমদ চৌধুরী ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী আতিকুর রহমান আতিকের সম্পদের পরিমাণ বেশি। তাদের দুজনেরই রয়েছে অঢেল সম্পদ। আর বাংলাদেশ কংগ্রেসের প্রার্থী জুনায়েদ মোহাম্মদ মিয়ার কোনো ব্যাংক ঋণ কিংবা দেনা-পাওনা নেই।

নির্বাচন কমিশনে প্রার্থীদের জমা দেয়া হলফনামা পর্যালোচনা করে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী- আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী হাবিবুর রহমান হাবিবের যৌথ মালিকানায় সর্বোচ্চ ৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ব্যাংক ঋণ রয়েছে। তবে তার নামে কোনো ফৌজদারি মামলা নেই।

স্নাতক পাস হাবিবুর রহমান হাবিব পেশায় ব্যবসায়ী। তিনি প্রবাসী পল্লী গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে পেশায় ব্যবসায়ী হলেও তার নিজের কোনো আয় নেই। কৃষিখাত থেকে তার স্ত্রীর বছরে ১ লাখ ২৭ হাজার ৪৫০ টাকা আয় হয়। অস্থাবর সম্পদ হিসেবে নিজের নামে নগদ ৮৭ লাখ ৫২ হাজার ৫ টাকা ও স্ত্রীর নামে নগদ ১ কোটি ৭৯ লাখ ৫৮ হাজার ৭৩০ টাকা রয়েছে। নিজ নামে ৫২ হাজার ২৪৪ টাকা ও স্ত্রীর নামে ৯ হাজার ৪৪৮ টাকা ব্যাংকে জমা রয়েছে। নিজের নামে রয়েছে ৩ হাজার ৫০০ শেয়ার, যার মূল্য ৭ লাখ ১০ হাজার টাকা। 

স্থাবর সম্পদ হিসেবে নিজ নামে ৫ লাখ ৩৯ হাজার ৩৯৮ টাকার অকৃষি জমি রয়েছে। নিজের নামে পূর্বাচলে ৭ কাঠার প্লট রয়েছে, যার মূল্য ১৮ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। যৌথ মালিকানায় তার ব্যাংক ঋণ রয়েছে। পূর্বাচল প্রবাসী পল্লী লিমিটেডের নামে ঋণের পরিমাণ হচ্ছে ৯ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। তিনি দক্ষিণ সুরমার ধরগাঁও রাজাবাড়ির (পার্ট) বাসিন্দা।

অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য (বহিষ্কৃত) শফি আহমদ চৌধুরী হলফনামায় নিজেকে বিএ পাস বলে উল্লেখ করেছেন। পেশা হিসেবে উল্লেখ করেছেন ইনডেন্টিং ব্যবসায়ী (রফতানি ব্যবসায়ী)। তিনি অ্যালবার্ট ডেভিট প্রাইভেট লিমিটেডের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তিনি ২০০৭ সালে করা মামলার আসামি (ধারা-৪০৬/৪২০/২০১/১০৯/৪১১/দণ্ডবিধি) ছিলেন। দক্ষিণ সুরমা থানার মামলা নং ২০(২) ২০০৭। পরে অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় তিনি মামলা থেকে বেকসুর খালাস পান। 

ব্যবসায়ী শফি চৌধুরীর বার্ষিক আয় ৮০ লাখ ১৩ হাজার ৫৮৮ টাকা। এর মধ্যে ব্যবসা থেকে ৫০ লাখ ৮৯ হাজার ৩২৭ টাকা, ঘর ভাড়া থেকে ২৭ লাখ ৯৮ হাজার ৯২৫ টাকা ও ব্যাংক ইন্টারেস্ট থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার ২৭৬ টাকা আয় করেন। নিজ নামে নগদ ও জমা মিলিয়ে ব্যাংকে রয়েছে ২ কোটি ৭৬ লাখ ৫১২ টাকা। কন্টিনেন্টাল ট্রাভেলস লিমিটেড, কন্টিনেন্টাল ফিশারি অ্যান্ড এগ্রো লিমিটেড, ট্রান্সকম সিকিউরিটি লিমিটেড, ন্যাশনাল টি কোম্পানি লিমিটেডসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তার নিজ নামে শেয়ার রয়েছে। অ্যালভার্ট ডেভিট (বিডি) লিমিটেডে রয়েছে ডিপোজিট মানি ও শেয়ার। 

পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত যৌথ মালিকানায় তিনি ৫০০ বিঘা জমির মালিক। রাজধানী ঢাকার গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর রোডে নিজ নামে ১ কোটি ১১ লাখ টাকা মূল্যের একটি বাড়ি রয়েছে। ৪৬ লাখ ২৮ হাজার ৮৪৭ টাকা মূল্যের একটি নতুন গাড়ি (রেঞ্জ রোভার জিপ)  ও ২ লাখ টাকা মূল্যের একটি পুরাতন গাড়ি রয়েছে।

এছাড়া বিভিন্ন ব্যবসায় তার ৩৯ কোটি ৯ লাখ ৩২ হাজার ৭৭৯ টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। স্থাবর ও অস্থাবর মিলিয়ে তিনি মোট ৪৯ কোটি ২৫ লাখ ৪ হাজার ৩৯৪ টাকা মূল্যের সম্পদের মালিক। তার ৭ কোটি ৫ লাখ ৮৩ হাজার ৫৭১ টাকা ঋণ রয়েছে। এক নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে ৬ কোটি ১৬ লাখ ৬ হাজার ২৬ টাকা ঋণ নিয়েছেন। সায়েরা চৌধুরীর কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন ৮৯ লাখ ৫৪৫ টাকা। তিনি দক্ষিণ সুরমার পশ্চিম দাউদপুরের বাসিন্দা। অতীতে এই নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য ছিলেন। সংসদ সদস্য থাকাকালে তার যে সকল অর্জন এর তালিকা হলফনামায় তিনি উল্লেখ করেন।

অন্যদিকে জাতীয় পার্টি মনোনীত প্রার্থী ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য আতিকুর রহমান আতিক বিএসসি পাস। হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে তিনি ফৌজদারি মামলার (১১৮২/২০০১) আসামি ছিলেন। নির্দোষ প্রমাণ হওয়ায় মামলাটি খারিজ হয়। পেশায় ব্যবসায়ী আতিক প্রিন্স গ্রুপ অব কোম্পানির চেয়ারম্যান অ্যান্ড ম্যানেজিং ডিরেক্টর। প্রিন্স রিয়েল এস্টেট (প্রা.) লি., প্রিন্স মেডিকেল সেন্টার ও সিলেট সিটি মেডিকেল সেন্টার নামে তিনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি। 

আতিক ব্যবসা থেকে বার্ষিক ১১ লাখ ২০ হাজার টাকা ও নির্ভরশীলরা ৩ লাখ ৪৭ হাজার টাকা আয় করেন। অস্থাবর সম্পদ হিসেবে নিজের নামে ২২ লাখ ৮ হাজার ৪৯৩ টাকা ও স্ত্রীর নামে ৮ লাখ ৪৫ হাজার টাকা নগদ রয়েছে। নিজের নামে ২০ লাখ ৭০ হাজার ১৬৯ টাকা ও স্ত্রীর নামে ৫ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা রয়েছে। নিজের নামে প্রিন্স রিয়েল এস্টেট (প্রা.) লি. এর ১৬ হাজার শেয়ার রয়েছে , যার মূল্য ১৬ লাখ টাকা। স্ত্রীর নামে একই প্রতিষ্ঠানের ২ হাজার শেয়ার রয়েছে , যার মূল্য ২ লাখ টাকা। ছেলে ওয়ালিউর রহমানের নামে একই প্রতিষ্ঠানের ২ হাজার শেয়ার রয়েছে , যার মূল্য ২ লাখ টাকা। 

নিজের নামে ১০ লাখ টাকার জিপ গাড়ি রয়েছে। ৩৫ লাখ টাকা মূল্যের প্রাডো গাড়ি যা তিনি এমডি হিসেবে ব্যবহার করেন। গাড়িটি কোম্পানির নামে। নিজের নামে ৭ লাখ টাকার ১০ ভরি স্বর্ণ ও স্ত্রীর নামে ১৭ লাখ ২৫ হাজার টাকার ২৫ ভরি স্বর্ণ, নিজের নামে ৯ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকার ও স্ত্রীর নামে ২ লাখ টাকার ইলেকট্রনিক সামগ্রী এবং নিজের নামে ২ লাখ টাকা ও স্ত্রীর নামে ১ লাখ টাকার আসবাবপত্র রয়েছে। 

নিজের নামে সিলেট মেডিকেল সেন্টারের আড়াই লাখ টাকার শেয়ার ও প্রিন্স মেডিকেল সেন্টারের ৩০ লাখ টাকার যন্ত্রপাতি রয়েছে। স্থাবর সম্পদ হিসেবে রয়েছে নিজের নামে দক্ষিণ সুরমার হরগৌরী মৌজায় ৩ লাখ ৫৬ হাজার টাকার ১৫ শতক জমি, হবিগঞ্জের লাখাইয়ে ৫ লাখ টাকা মূল্যের ধানের জমি। স্ত্রীর নামে ঢাকার সাতারকুল মৌজায় (নিকুঞ্জ) ১০ কাঠা জমি রয়েছে। যার মূল্য ৮০ হাজার টাকা। যৌথ মালিকানায় মোগলাবাজারের জাহানপুরে ৪০ লাখ টাকার ৮ বিঘা জমি রয়েছে।

নিজের নামে ঢাকার নিকুঞ্জ-২ জোয়ার সাহারা মৌজায় রাজউক থেকে প্রাপ্ত ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকার জমি, রামপুরা উলন মৌজায় ৮০ হাজার টাকার ৪ কাঠা জমি, হবিগঞ্জের শ্যামলী আবাসিক এলাকায় সাড়ে ৭ লাখ টাকার সাড়ে ৫ শতক জমি এবং ৪৫ হাজার টাকার ৩৬ শতক জমি রয়েছে। হবিগঞ্জের শ্যামলী আবাসিক এলাকায় ৩৫ লাখ টাকার বাড়ি, ঢাকার (বারিধারা নর্থ) কালাচাঁদপুরে সাড়ে ৯ লাখ টাকার ফ্ল্যাট ও বারিধারা ৬৬ পার্ক রোডে ৪০ লাখ ৫৭ হাজার ৫২৫ টাকা মূল্যের ফ্ল্যাটের অর্ধেক মালিকানা রয়েছে তার। 

স্ত্রীর নামে গুলশান-২ (রোড-৩৫) এ ২৭ লাখ ৪৫ হাজার টাকার ফ্ল্যাট ও বারিধারা ৬৬ পার্ক রোডে ৪০ লাখ ৫৭ হাজার ৫২৫ টাকা মূল্যের ফ্ল্যাটে অর্ধেক মালিকানা রয়েছে।

ছেলে ওয়ালিউর রহমানের নামে রয়েছে ঢাকার কালাচাঁদপুরে ২ লাখ ২৫ হাজার টাকার ফ্ল্যাট। যৌথ মালিকানায় রয়েছে দক্ষিণ সুরমার মোগলাবাজারের জাহানপুরে ৩ কোটি ২০ লাখ টাকার পৈতৃক বাড়ি ও অকৃষি জমি। একই এলাকায় ১ কোটি টাকার দালানসহ বাসস্থান , নগরীর ধোপাদিঘীর উত্তরপাড়ে ৩ কোটি টাকার পৈতৃক বাড়ি, ঢাকার গুলশান-১১৪ কোম্পানির নামে যৌথ মালিকানায় ১৯ লাখ ৯০ হাজার ৪৭ টাকার অ্যাপার্টমেন্ট, বনানীতে (রোড-২৩ , ব্লক- বি) ১২ লাখ ৯৭ হাজার টাকার অ্যাপার্টমেন্ট ও বারিধারায় পার্ক রোডে কোম্পানির নামে যৌথ মালিকানায় ৯০ লাখ টাকার আড়াই হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট রয়েছে।

আতিক, তার স্ত্রী ও ছেলে মিলে তিনজনের নামে ১ কোটি ২০ লাখ টাকার ব্যাংক ঋণ রয়েছে। হোম লোন হিসেবে স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক থেকে যৌথভাবে এই ঋণ নেওয়া হয় বলে হলফনামায় তিনি উল্লেখ করেন। আতিক দক্ষিণ সুরমার মোগলাবাজারের জাহানপুরের বাসিন্দা।

আর বাংলাদেশ কংগ্রেসের মনোনীত প্রার্থী জুনায়েদ মোহাম্মদ মিয়া স্বশিক্ষিত। হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী- তার বিরুদ্ধে কখনো মামলা হয়নি। পেশায় কৃষক জুনায়েদ কৃষি থেকে বার্ষিক ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা ও দোকান ভাড়া থেকে ২০ হাজার টাকা আয় করেন। অস্থাবর সম্পদ হিসেবে রয়েছে নিজের নামে নগদ ২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা, ব্যাংকে জমা সাড়ে ৩ লাখ টাকা, ৬০ হাজার টাকার ১ ভরি স্বর্ণ, ১০ হাজার টাকার মোবাইল সেট , ৬০ হাজার টাকার আসবাবপত্র। স্থাবর সম্পদ রয়েছে নিজের নামে ১০ দশমিক ১৪৫ একর কৃষি জমি, ৩ লাখ টাকার ১ শতক জমি, পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত ৮ কক্ষের বসতঘর ও স্ত্রীর নামে ১ দশমিক ৬৯ একর কৃষি জমি। তিনি বালাগঞ্জ উপজেলার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা। তার কোনো ব্যাংক ঋণ নেই।

সিলেট -৩ আসনের উপনির্বাচনে রিটার্নিং অফিসার ও সিলেটের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মুহাম্মদ ইসরাইল হোসেন বলেন, বিধি অনুযায়ী মনোনয়ন ফরমের সঙ্গে সংযুক্ত করে প্রার্থীদের মোট সম্পদের বিবরণী জমা দিতে হয়। আইনজীবীর মাধ্যমে হলফ করে প্রার্থীর স্বাক্ষরসহ হলফনামা জমা দিতে হয়। এতে কোনো তথ্য গোপন করলে আইন অনুযায়ী প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যাবে। কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে এমন নির্দিষ্ট কোন অভিযোগ থাকলে ভোট গ্রহণের পরেও অভিযোগ করা যায়। এমনকি এ বিষয়ে কেউ তথ্য-প্রমাণসহ আদালতেও যেতে পারবেন।

প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ১১ মার্চ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী মারা যান। এরপর ১৫ মার্চ আসনটি শূন্য ঘোষণা করা হয়। আগামী ২৮ জুলাই সিলেট-৩ আসনের উপনির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোটগ্রহণ হবে। তফশিল অনুযায়ী ২৪ জুন মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন এবং প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হবে ২৫ জুন।

তুহিন আহমদ/আরএআর