চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর রংপুরে আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করেছেন শহীদ আবু সাঈদের স্বজনরাসহ জুলাই যোদ্ধারা।

সোমবার (১৭ নভেম্বর) দুপুরে রায় ঘোষণার পর রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর জাফরপাড়া গ্রামে মিষ্টি বিতরণের মধ্য দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেন আবু সাঈদের ভাইসহ স্বজনরা। এসময় তারা একে অপরকে মিষ্টি খাইয়ে দেন এবং আশেপাশের মানুষদেরও মিষ্টি খাওয়ানো হয়। রায় ঘোষণার পর এক প্রতিক্রিয়ায় শহীদ আবু সাঈদের পরিবারের সদস্যরা পলাতক শেখ হাসিনাসহ অন্যান্য আসামিদের দ্রুত দেশে এনে ফাঁসির রায় কার্যকর করার দাবি জানান।

শহীদ আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন বলেন, আমি রায়ে খুশি কিন্তু বিচার দেখতে চাই। আমার ছেলে শহীদ হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশ আমার ছেলেকে সরাসরি গুলি করে হত্যা করেছে। শেখ হাসিনাকে বাংলার মাটিতে নিয়ে এসে রায় কার্যকর করতে হবে।

আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, আমরা সবার বিচার চাই। যারা হুকুম দিয়েছে, যারা গুলি করেছে সবাইকে ফাঁসি দিতে হবে। আমি মা, আজ বুঝতে পারছি ছেলে হারানোর কষ্ট। আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে আমার মতো অনেক মা, বোন, ভাই সন্তান হারিয়েছে, স্বামী হারিয়েছে। আর যেন আমার মতো কোনো মায়ের বুক এভাবে খালি না হয়, সেজন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

আবু সাঈদ হত্যা মামলার বাদী ও বড়ভাই রমজান আলী বলেন, আবু সাঈদকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তা শুধু বাংলাদেশ নয় পুরো বিশ্ব দেখেছে। প্রকাশ্যে পুলিশ তাকে গুলি করে হত্যা করেছে। সেই ভিডিও ফুটেজ সবাই দেখেছে। এটা তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী স্বৈরাচার শেখ হাসিনা এবং তার মন্ত্রিপরিষদের নির্দেশে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। তাদের নির্দেশ পেয়ে পুলিশ সাহস করে গুলি করে আবু সাঈদকে শহীদ করে দিয়েছেন। আমরা এমন বিচার দেখতে চাই, খুনিরা যে দেশেই পালিয়ে থাকুক তাদের ধরে এনে শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। তাদেরকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে বাংলার মানুষকে দেখাতে হবে এমন স্বৈরাচারের বিচার কী হতে পারে।  

এদিকে শেখ হাসিনার ফাঁসির আদেশ হওয়ার পর আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সোমবার বিকেলে শহীদ আবু সাঈদের সহযোদ্ধারা ক্যাম্পাস থেকে একটি আনন্দ মিছিল নিয়ে শহীদ আবু সাঈদ চত্ত্বর প্রদক্ষিণ করে। এ সময় তারা শিক্ষার্থী ও পথচারীদের মাঝে মিষ্টি বিতরণ করেন। সেই সাথে শেখ হাসিনার ফাঁসির আদেশ গণঅভ্যূত্থানের পর আরেকটি বিজয় বলে তারা আখ্যায়িত করেন এবং একে-অপরের সাথে কোলাকুলি করে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে মিষ্টি বিতরণকালে শিক্ষার্থী শামসুর রহমান সুমন বলেন, বেরোবির গর্ব শহীদ আবু সাঈদ ভাইয়ের আত্মত্যাগের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলন অন্যরকম রূপ নেয়। যে ফ্যাসিস্টের নির্দেশনায় প্রাণ হারায় আবু সাঈদ ভাই। সেই ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ায় আমরা শিক্ষার্থীরা অনেক খুশি। এ রায় একটি নতুন ইতিহাস রচনা করলো।

এছাড়াও রংপুরের জুলাইযোদ্ধারা প্রেসক্লাব চত্বর, জাহাজ কোম্পানী মোড় ও টাউন হল এবং জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ চত্বর এলাকায় মিষ্টি বিতরণ করার পাশাপাশি উল্লাস করেছেন। তারা রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে তা দ্রুত কার্যকর করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

প্রেসক্লাব চত্ত্বরে অটোরিকশা চালক ও পথচারীদের মিষ্টি খাইয়ে দেন জুলাই যোদ্ধা সীমান্ত হোসেন। তিনি বলেন, এ রায়ের মাধ্যমে জুলাই আন্দোলনে শহীদের আত্মা কিছুটা হলেও শান্তি পেল। আমাদের যুদ্ধ সফল। ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে দ্রুত দেশে নিয়ে এসে ফাঁসির দঁড়িতে ঝোলানো হোক।

বিকেলে নগরীর টাউন হল থেকে জাতীয় ছাত্র শক্তি মহানগর কমিটির উদ্যোগে একটি মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা নগরীর গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
 
রায় ঘোষণার পর এক প্রতিক্রিয়ায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড.শওকাত আলী বলেন, আন্দোলনে অনেকেই শহীদ হয়েছেন তার মধ্যে শহীদ আবু সাঈদ অন্যতম। আবু সাঈদকে কেন্দ্র করে এ মামলার যে রায় হয়েছে এতে শুধু সাধারণ শিক্ষার্থীরা নয় দেশের আপামর জনতা অনেক খুশি। আবু সাঈদ হত্যা মামলা ট্রাইব্যুনাল-২ এ আছে সেটারও আমরা খুব দ্রুত রায় পাবো। আবু সাঈদের রক্তের কাছে আমরা ঋণী হয়ে থাকবো চিরকাল। আগামীতে যারাই ক্ষমতায় আসবেন তারা এ দৃষ্টান্ত মনে রেখে কাজ করবেন।

প্রসঙ্গত, সোমবার (১৭ নভেম্বর) দুপুরে বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই মামলার রায় ঘোষণা করেন। এই ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পাশাপাশি এই মামলার অন্য আসামি হলেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তিন আসামির মধ্যে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল পলাতক।

এই মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া একমাত্র আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন নিজের দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হিসেবে ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দিয়েছেন। আদালত চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনের পাঁচ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এআরবি