নীলফামারীর ছয়টি উপজেলার প্রায় ১৪ লাখ মানুষের কাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট আধুনিক সদর হাসপাতালকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করে নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে রূপান্তর করা হয় ২০১৯ সালে। তবে হাসপাতালে চিকিৎসকের ৫৭টি পদের বিপরীতে ৪০টি পদই রয়েছে শূন্য! মাত্র ৩০ শতাংশ চিকিৎসক দিয়েই খুঁড়িয়ে চলছে হাসপাতালটির স্বাস্থ্যসেবা।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালে ৬০ জন নার্সের পদ খালি। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর ৬১টি পদে থাকলেও পদায়ন নেই ৪৪ পদে। প্যাথলজি বিভাগে কোনো চিকিৎসক না থাকায় বিভিন্ন রোগ পরীক্ষা নিরীক্ষায় একমাত্র ভরসা মাত্র ১ জন ল্যাব ট্যাকনিশিয়ান। ফলে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে, অনেকেই সেবা না পেয়ে বাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন। এ রকম নানা সংকটে জর্জরিত নীলফামারীর স্বাস্থ্য খাত।

চিকিৎসারা বলছেন, নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে শিশু, চর্ম ও যৌন, অর্থোপেডিকস ও প্যাথলজি বিভাগে কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। আবাসিক চিকিৎসক ও আবাসিক সার্জনের পদও খালি। রেজিস্ট্রার, সহকারী রেজিস্ট্রার ও সহকারী সার্জনের ১৭টি পদও ফাঁকা। ফলে জরুরি বিভাগ, বহির্বিভাগ ও অন্তর্বিভাগে কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসাসেবা দেওয়া কষ্টকর হয়ে উঠেছে।

এ ছাড়া ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল হলেও এখানে শয্যা রয়েছে ১৭০টি। হাসপাতালের পুরোনো ভবনে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট আর নতুন ৮ তলা ভবনে ১৫০ শয্যা হওয়ার কথা থাকলেও তা নির্মিত হয়েছে ৬ তলা পর্যন্ত। অনির্মিত ২টি তলায় ২০টি কেবিন আর ৬০টি বেড থাকার কথা ছিল। কিন্তু ওই ২টি তলা নির্মাণ না হওয়ায় শয্যাসংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১৭০টিত।

হাসপাতালটিতে দীর্ঘদিন থেকে হৃদরোগ বিভাগ বন্ধ, বিকল হয়ে পড়ে আছে রোগ নির্ণয় করার কয়েকটি মেশিন। হাসপাতালে নেই স্টোর রুম। বিভিন্ন ভবনের পরিত্যক্ত ঘরে রাখা হচ্ছে ওষুধপথ্য। ফলে ওষুধ, অস্ত্রোপচারের চিকিৎসা সরঞ্জামের নানা জিনিসপত্র থাকছে অরক্ষিত, অবহেলায়।

তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী নীলফামারী গণপূর্ত বিভাগ আইসিইউ ও আইসোলেশন ওয়ার্ড চালু করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।

নীলফামারী সদর উপজেলার কুন্দুপুকুর মাজার এলাকার আহিদুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সকাল ৯টায় এসেছি, টিকিট নিতেই ৪০ মিনিট লাগছে, রোগীদের দীর্ঘ সারি, ডাক্তার দেখাইতে আরও ২ ঘণ্টা লাগতে পারে। এটা কি হাসপাতাল?

ডোমার উপজেলার সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন ভেগডাবুড়ি এলাকার রহিমা বেগম এক মাস বয়সের শিশুর চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে ৪ দিন থেকে আছেন। তিনি বলেন, বাইরে থেকে ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা নিয়ে এসে এখানে ভর্তি হয়ে আছি। এখানে নার্সরা আছে, ডাক্তাররা আছে। তবে শিশু বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নেই।

কচুকাটা এলাকার লুতনা আক্তার বলেন, টিকিট কেটে ২ ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়ায় আছি। আরও কতক্ষণ সময় লাগবে, তা বলতে পারছি না। এভাবে গরমের মধ্যে গাদাগাদি করে চিকিৎসা নিতে এলে রোগ কমবে না, বাড়বে আরও।

বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা আব্দুল হাই বলেন, আমার কোমরের ব্যথা। এ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নাই, তবু আসলাম। কারণ, বাইরে ডাক্তার দেখানোর মতো টাকা নাই আমার। সরকারি হাসপাতলেই ভরসা গরিবের।

নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের নার্সিং সুপারভাইজার কল্পনা রানী দাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনাকালীন এই সময়ে স্বল্পসংখ্যক নার্স দিয়ে দায়িত্ব পালন করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। রোগী ও তাদের স্বজনদের কোনোভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানানো সম্ভব হচ্ছে না। তবু আমরা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। সেবিকা পদে প্রয়োজনীয় জনবল পেলে আমরা কাঙ্ক্ষিত সেবা প্রদান করতে পারব।

নাক কান গলা (ইএনটি) বিভাগের সিনিয়র বিশেষজ্ঞ ডা. জাহাঙ্গীর আলম জানান, অন্তর্বিভাগ ও বহির্বিভাগে যে পরিমাণ রোগী আসে, চিকিৎসক-সংকটের কারণে তাদের দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। এতে রোগীদের বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হয়। প্রত্যাশিত সময়ের মধ্যে রোগীদের কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। কারণ একজন চিকিৎসককে অন্তর্বিভাগে সেবা দেওয়ার পরেই বহির্বিভাগে রোগী দেখতে হয়। রোগীর দীর্ঘ লাইন থাকে। তখন বেশি সময় নিয়ে রোগী দেখা সম্ভব হয় না।

নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মেজবাহুল হাসান চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালে ৩০ শতাংশ চিকিৎসক নিয়ে সেবা দিয়ে গিয়ে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। এরপরও গত ১ বছরে আমরা জরুরি বিভাগে ৭০ হাজার ও বহির্বিভাগে ১ লাখ ৬০ হাজার রোগীকে সেবা দিয়েছি।

তিনি জানান, কয়েকটি বিভাগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। চিকিৎসকের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোও খালি। প্যাথলজি বিভাগে কোনো চিকিৎসক না থাকায় নির্ভর করতে হয় ১ জন টেকনিশিয়ানের ওপর। এতে সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। আমাদের কোনো স্টোর রুম নেই। হাসপাতালে মাত্র একটি মুক্তিযোদ্ধা কেবিন আছে। হাসপাতলে মোট ১৭০টি বেড দিয়েই অজ্ঞাত কারণে ঝুঁকি নিয়েই ২৫০ শয্যার হাসপাতাল চালাতে হচ্ছে।

নীলফামারী গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তৌহিদুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাসপাতালের নতুন ভবনের ৮ তলাবিশিষ্ট ফাউন্ডেশন দিয়ে অর্থ বরাদ্দ অনুযায়ী ৬ তলা পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ৭ তলায় আইসোলেশন ওয়ার্ড করার জন্য প্রস্তাব অনুমোদিত হয়েছে। তবে সরকারের নির্দেশনা আর অর্থ বরাদ্দ পাওয়া গেলে বাকি দুই তলা নির্মাণন করা হবে।

স্থানীয় সচেতন নাগরিক সমাজ বলছে, নানা সংকটে জর্জরিত নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে দ্রুততম সময়ে সমাধান করে নীলফামারী জেলার ছয়টি উপজেলার মানুষের প্রত্যাশিত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

এনএ