খুন হওয়া মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষ বিদায়
রংপুরের তারাগঞ্জে নিজ বাড়িতে নৃশংসভাবে খুন হওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা যোগেশ চন্দ্র রায়কে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শেষ বিদায় জানানো হয়েছে। সোমবার (৮ ডিসেম্বর) বিকেলে তার দান করা চাকলা শ্মশানে তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হলে স্বজন ও এলাকাবাসীর কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে রহিমাপুর গ্রাম।
শনিবার (৬ ডিসেম্বর) দিবাগত রাতে যোগেশ চন্দ্র রায় ও তার স্ত্রী সুর্বণা রায়কে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। পরদিন রোববার সকালে মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরে ময়নাতদন্ত শেষে আজ বিকেল সাড়ে ৩টায় যোগেশ চন্দ্র রায় ও তার স্ত্রী সুর্বণা রায়ের মরদেহ বাড়িতে পৌঁছায়।
বিজ্ঞাপন
এরপর বিকেল সাড়ে ৪টায় যোগেশ চন্দ্র রায়ের দান করা চাকলা শ্মশানেই রাষ্ট্রীয় সম্মান জানিয়ে তাকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। এ সময় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মনাব্বর হোসেন ও তারাগঞ্জ থানার ওসি রুহুল আমিনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে গার্ড অব অনার শেষে দাহক্রিয়া সম্পন্ন করা হলে আহাজারিতে ভেঙে পড়েন স্বজনরা। নৃশংস এ হত্যার ঘটনায় যোগেশ চন্দ্র রায়ের বড় ছেলের শোভেন চন্দ্র রায় বাদী হয়ে অজ্ঞাত ১০ থেকে ১৫ জনকে আসামি করে রোববার তারাগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
বিজ্ঞাপন
পুলিশ ও স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রোববার সকালে নিজ বাড়ির ডাইনিং রুম থেকে যোগেশ চন্দ্র রায় (৭৫) এবং তার স্ত্রী সুবর্ণা রায়ের (৬০) রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের উত্তর রহিমাপুর এলাকার নিজ বাড়ি থেকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
এদিন সকালে ডাকাডাকি করেও ভেতর থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে প্রতিবেশীরা মই বেয়ে বাড়ির ভেতরে ঢোকেন। বাড়ির প্রধান ফটকের চাবি পেয়ে দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে তারা ডাইনিং রুমে যোগেশ চন্দ্র রায় এবং রান্নাঘরে সুবর্ণা রায়ের রক্তাক্ত মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। পরে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যায়।
এদিকে সোমবার বিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহগুলো গ্রামে পৌঁছালে শোকের আবহ তৈরি হয়। লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স আসতেই একনজর দেখতে বাড়ির আঙিনা ও আশপাশে হাজারো মানুষের ভিড় জমে।
প্রত্যক্ষদর্শী দীপক চন্দ্র রায় জানান, তার পরিবার প্রায় ৫০ বছর ধরে যোগেশ রায়ের বাড়ির দেখাশোনা করেন। প্রতিদিনের মতো সকালে কাজ করতে গিয়ে ঘরের ভেতর কোনো শব্দ না পেয়ে সন্দেহ হয় তার। পরে আশপাশের লোকজনকে ডেকে বাড়িতে ঢুকে তাদের মরদেহ দেখতে পান।
পরিবার ও স্থানীয়দের বরাতে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধা যোগেশ চন্দ্র রায় ছিলেন উত্তর রহিমাপুর নয়াহাট মুক্তিযোদ্ধা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ২০১৭ সালে তিনি অবসরে যান। তার দুই ছেলে- বড় ছেলে শোভেন চন্দ্র রায় জয়পুরহাটে র্যাবে চাকরি করেন, ছোট ছেলে রাজেশ খান্না ঢাকায় পুলিশে কর্মরত। নিজেরা গ্রামের বাড়িতে না থাকায় বাবা-মা দুজনই একা থাকতেন।
বড় ছেলে শোভেন চন্দ্র রায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার বাবা-মাকে শেষ বয়সে এসে খুন হতে হবে কল্পনাও করিনি। আইনের আশ্রয় নিয়েছি। যারাই জড়িত থাকুক না কেন কেউ যেন ছাড় না পায়।
বড় পুত্রবধূ কল্যাণী রানী বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। জ্ঞান ফিরলেই বিলাপ করে বলছিলেন, কি দোষে তাদের হত্যা করল? তারা আর কয়দিন বাঁচতেন? খুনিদের বিচার চাই।
কুর্শা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আফজালুল হক বলেন, গ্রামে এ রকম ভালো পরিবার নেই বললেই চলে। যোগেশ চন্দ্র রায় অত্যন্ত বিনয়ী ও দানশীল মানুষ ছিলেন। তার মৃত্যুতে গোটা এলাকায় শোক নেমে এসেছে।
তারাগঞ্জ উপজেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আলী হোসেন বলেন, বিজয়ের মাসে এ রকম বর্বর হত্যা মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের নিজেদের জীবনও এখন অনিরাপদ মনে হচ্ছে। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার না করলে আন্দোলনে নামতে বাধ্য হব।
তারাগঞ্জ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রুহুল আমিন বলেন, মুক্তিযোদ্ধা যোগেশ চন্দ্র রায় ও তার স্ত্রীকে হত্যা করার ঘটনায় তাদের বড় ছেলে অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মুক্তিযোদ্ধা যোগেশ চন্দ্র রায় ও তার স্ত্রী সুবর্ণা রায়ের মরদেহ সৎকার করা হয়েছে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর