শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস
গেজেটে নেই শহীদ সেলিনা পারভীন
আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের শেষলগ্নে দেশের মানুষ যখন চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, ঠিক তখন এই দিনে দখলদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার আল-বদর, আল-শামসরা বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়নের কাজ। ইতোপূর্বে সরকার দুই দফায় এখন পর্যন্ত ৩৩৪ শহীদ বুদ্ধিজীবীকে গেজেটের মাধ্যমে স্বীকৃতি দিয়েছে। তার মধ্যে ফেনীর ১০ জন বুদ্ধিজীবীর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অথচ আজও গেজেটে অন্তর্ভুক্ত হয়নি শহীদ কবি ও সাংবাদিক ফেনীর সন্তান সেলিনা পারভীন।
বিজ্ঞাপন
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দুই দফায় এখন পর্যন্ত ৩৩৪ শহীদ বুদ্ধিজীবীকে গেজেটের মাধ্যমে স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। প্রথম গেজেটে অন্তর্ভুক্ত ১৯১ জন বুদ্ধিজীবীর মধ্যে ফেনীর ৮ জনের নাম রয়েছে। তারা হলেন-জহির রায়হান, ড. আ.ন.ম ফজলুল হক মহী, ডা. ক্যাপ্টেন বদিউল আলম চৌধুরী, প্রকৌশলী শফিকুল আনোয়ার, ডা. মেজর রেজাউর রহমান, শহীদুল্লাহ কায়সার, ড. সিদ্দিক আহমেদ ও ড. সিরাজুল হক খান।
দ্বিতীয় পর্বে ফেনীর আরও তিন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম গেজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তারা হলেন- ড. রফিক আহমেদ, প্রকৌশলী শফিকুল আনোয়ার ও প্রকৌশলী সেকান্দর হায়াত চৌধুরী। এর মধ্যে প্রকৌশলী শফিকুল আনোয়ারের নাম দুই পর্বেই রয়েছে। তবে এখনো স্বীকৃতি পাননি কবি ও সাংবাদিক সেলিনা পারভীন।
বিজ্ঞাপন
শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা শাওন মাহমুদ সেলিনা পারভীন স্মরণে লেখেন, ‘সেদিন শহরে কারফিউ চলছিল। রাস্তায় পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী আত্মসমর্পণের জন্য বিমান থেকে চিঠি ফেলা হচ্ছে। হঠাৎ দূরে একটা গাড়ির আওয়াজ হলো। সুমনদের (সেলিনা পারভীনের ছেলে) বাড়ির উল্টো দিকে খান আতার বাসার সামনে মাইক্রোবাস ও লরি থামলো। সেই বাসার প্রধান গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেল আলবদররা। তাদের সবাই একই রঙের পোশাক পরা ও মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকা। সেলিনা পারভীনের ফ্ল্যাটে এসে একসময় কড়া নাড়ে তারা। তিনি নিজে দরজা খুলে দেন। লোকগুলো তার পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয় এবং এই সময় সেলিনা পারভীনের সাথে লোকগুলোর কথা হয়। এরপর তারা তাকে ধরে নিয়ে যায়। বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবীর লাশ রায়ের বাজার বধ্যভূমির ডোবায় পাওয়া গিয়েছিল। আর কিছু মিরপুর বধ্যভূমিতে। সেলিনা পারভীনের গলিত লাশও ১৮ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে পাওয়া গিয়েছিল। অত্যাচারে বীভৎস হওয়া আর ডোবায় পচা জলে গলে যাওয়া লাশ চিহ্নিত করা খুব কঠিন ছিল তখন। তার পায়ের সাদা মোজা দেখে, তাকে চিনতে পেরেছিল পরিবারের স্বজনরা। অত্যন্ত শীত কাতুরে সেলিনা পারভীন ডিসেম্বরের সেই ক’টা দিন প্রচণ্ড শীতে, রায়ের বাজারের ডোবায় পড়ে ছিলেন, নিথর, লাশ হয়ে।’
‘শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সাংবাদিকতা পদক ২০২০’ প্রদান অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক ভিপি ও অধ্যক্ষ মাহফুজা খানম বলেছিলেন, ‘রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে পাওয়া একমাত্র নারী ছিলেন সেলিনা পারভীন। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকে কোনোভাবে স্বীকৃতির কথা নেই, তার নাম উচ্চারিত হয় কিনা আমার জানা নেই। রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল, তাকে আগামী প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করা। কিন্তু সরকারিভাবে সেটি করা হয়নি।’
সেলিনা পারভীনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন বিখ্যাত নারী অধিকার কর্মী মালেকা বেগম। তিনি সেলিনা পারভীনকে নিয়ে স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, ‘১৩ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় কয়েকজন এসে বলল, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডাক পড়েছে, যেতে হবে। সুমন (সেলিনা পারভীনের একমাত্র ছেলে) তখন ৮ বছর বয়সের ছিল। সব স্মরণ আছে তার। বলেছে, তেল মাখিয়ে মা তাকে মামার সঙ্গে ছাদে পাঠিয়ে মোড়ায় বসে রান্না করছিলেন। বললেন, পরে যাবেন কারফিউ শেষ হোক। ওরা সুযোগ দিলো না। সুমন চেয়েছিল সঙ্গে যেতে। অনুমতি মেলেনি।’
‘ঘাতকদের সাথে যাওয়ার সময় ছেলে সুমনকে বলে গিয়েছিলেন কাজ শেষ করে দ্রুতই ফিরবেন। কিন্তু তার আর ফেরা হয়নি। মিরপুরের বধ্যভূমিতে পিঠমোড়া করে হাত বাঁধা, আঙুলের নখ উপড়ানো, গুলিতে ঝাঁঝরা, বেয়োনেটে ক্ষত-বিক্ষত, অর্ধগলিত অনেক মরদেহ উদ্ধার করা হয়। যেগুলো ছিল স্বাধীনতাকামী বাঙালি শিক্ষক, ডাক্তার, চিকিৎসক, অধ্যাপক, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ অন্যান্য পেশার আলোকিতজনের। হতভাগ্য এই গুণীজনদের মধ্যে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীনকে খুব সহজেই শনাক্ত করা গিয়েছিল। পরনে সাদা শাড়ি, সাদা জুতা আর মোজা থাকায় খুব সহজেই চেনা গিয়েছিল এটা সুমনের মা, সেলিনা পারভীন।'
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সাংবাদিকতার স্বীকৃতি স্বরূপ জাতীয় প্রেসক্লাবে শহীদ সাংবাদিকদের নামের ‘নাম ফলকে’ সেলিনা পারভীনের নাম অঙ্কিত আছে। শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ‘শহিদ বুদ্ধিজীবী সিরিজ ৯১’ এ তার নামে ডাক টিকেট প্রকাশ করেছে (১৪ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালে)। সরকার পাঠ্যপুস্তকের পঞ্চম শ্রেণির বইয়ে তার ওপর তথ্য সংযোজন করেছে। বাংলা একাডেমি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকায় ও প্রকাশিত বই “শত শহীদ বুদ্ধিজীবী গ্রন্থ” ও “শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থ” এবং “স্মৃতি-৭১” (৪র্থ খণ্ড) এ তার ওপর বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে । ড. রফিকুল ইসলাম সম্পাদিত বই “বীরের এ রক্ত শ্রোত মাতার এ অশ্রুধারা” ও ফরিদা আক্তার সম্পাদিত “মহিলা মুক্তিযোদ্ধা গ্রন্থ” এ তার কথা লেখা হয়েছে। রক্তের ঋণ সংগঠন প্রকাশিত গ্রন্থ “শহিদ সাংবাদিক” এবং লেখিকা-সাহিত্যিক ও সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপিকা পান্না কায়সার সম্পাদিত বই “হৃদয়ে-একাত্তর” (প্রথম খন্ড) এ তার ওপর বিশদভাবে লেখা আছে। প্রিপ ট্রাস্ট কর্তৃক ড. নিবেদিতা দাশ পুরকায়স্থ সম্পাদিত বই “মুক্ত মঞ্চে নারী” তে সেলিনা পারভীনের বীর গাঁথা লিপিবদ্ধ হয়েছে। বৃটিশ চ্যানেল ফোর কর্তৃক “ওয়ার ক্রাইম ফাইল্স” এবং বিবিসি কর্তৃক “হাউ দ্যা ইস্ট ওয়াজ ওন” তথ্যচিত্রে তার ওপর তথ্য ও আলোকচিত্র সংযোজিত আছে। জাতীয় জাদুঘরে এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে তার ব্যবহৃত সামগ্রী সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য সংরক্ষিত আছে। সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় হতে তাকে বিশেষ স্বীকৃতিপত্র (৭১ এর শহীদ হিসেবে) দিয়েছে। প্রশিকার অর্থায়নে শামিম আখতারের নির্দেশনায় শহীদ বুদ্ধিজীবী সেলিনা পারভীনের জীবনের ছায়া অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে চলচিত্র “শিলালিপি”, এই ছবিটি উৎসর্গও করা হয়েছে তাকে। ঢাকার মৌচাক মোড় হতে মগবাজার পর্যন্ত রাস্তাটিতে এবং এর উভয় পার্শ্ব “শহিদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়ক” নামে নামকরণ করা হয়।
১৯৬৯’র গণঅভ্যুত্থান আন্দোলনে উত্তাল বাংলাদেশ। জাতির ক্রান্তিকালে সেলিনা পারভীন নিজেও শরিক হয়েছিলেন এ আন্দোলনে। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন ৬৯-এর আন্দোলনে, ২১ ফেব্রুয়ারির সভা কিংবা পল্টনের জনসভায়। যোগ দিতেন শহীদ মিনার থেকে বের হওয়া নারীদের মিছিলে। শরিক হতেন বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদ সভায়ও।
অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সারের মতো ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে সমাজতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল হয়ে পড়েন তিনি। এরই মধ্যে শুরু হলো মহান মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেলিনা পারভীন কোথাও পালিয়ে যাননি। ঢাকায় নিজ বাসায় অবস্থান করেছিলেন পরিবার নিয়ে। যুদ্ধকালীন সময়ে তরুণরা তার বাসায় গিয়ে খাওয়া ও প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র সংগ্রহ করে চলে যেতেন।
১৯৩১ সালের ৩১ মার্চ ফেনীতে জন্মগ্রহণ করেন সেলিনা পারভীন। তার বাবা আবিদুর রহমান শিক্ষকতা করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের ফেনীর বাড়ি দখল হয়ে যায়। এরপর তারা চলে যান ঢাকায়।
এদিকে প্রতিবছর সারা দেশের মতো ফেনীতেও নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে পালিত হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। দিবসটি এলেই উচ্চারিত হয় তাদের নাম, দিবসটি চলে গেলেই আবারও এক বছরের জন্য স্মৃতির অতলে হারিয়ে যান তারা। এভাবেই চলছে বছরের পর বছর। শুধু দিবসকেন্দ্রিক কর্মসূচির বাইরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতি স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ ও তাদের অবদানকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য উদ্যোগের প্রয়োজন বলে মনে করছেন ফেনীর সচেতন মহল।
এ ব্যাপারে সমাজকর্মী আসাদুজ্জামান দারা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বুদ্ধিজীবীদের আমরা প্রাপ্য সম্মান দেখাতে পারিনি। আগে যারা ছিল তারাও পারেননি, আবার পরবর্তী প্রজন্ম স্মরণ করবে এমন কিছু আমরাও করতে পারছি না। এ ছাড়া, বুদ্ধিজীবীদের ব্র্যান্ডিং করা, তাদের বীরত্বগাঁথা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা প্রশাসনের দায়িত্ব থাকলেও তা করেনি। এসব আমাদের সামগ্রিক ব্যর্থতা। ফেনীতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামে কোনো নামফলক বা ম্যুরাল করা হয়নি। আবার করলেও সংরক্ষণ নেই। সবমিলিয়ে শহীদ সেলিনা পারভীনের স্বীকৃতি না পাওয়ার বিষয়টিও সরকারের উদাসীনতা বলা যায়।
তারেক চৌধুরী/এএমকে