অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবাকে হারিয়েছেন জান্নাতুল আরফিন। এরপর থেকেই শুরু হয় জীবন সংগ্রাম। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় আরফিন। সন্তানদেন বড় করতে একাই লড়াই করছেন আরফিনের মা শাহিদা আক্তার। বড় মেয়ের পড়াশোনার জন্য স্বামীর ভাগে পাওয়া জমিটিও বিক্রি করে দিতে হয় শাহিদা আক্তারকে। তবে তার কষ্ট বিফলে যায়নি। মেডিকেলে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছেন জান্নাতুল আরফিন। কিন্তু অভাব এখনো তাড়া করে বেড়াচ্ছে এই পরিবারকে।

জান্নাতুল আরফিন নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার ডুমুরিয়া ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের কইয়াজলা গ্রামের আনসার আলী ভুঁইয়া বাড়ির মৃত আব্দুল ওয়াদুদ ও শাহিদা আক্তার দম্পতির বড় মেয়ে। তিনি সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। তার এই সাফল্যে আনন্দিত পরিবার, শিক্ষক ও এলাকাবাসী।

নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার ডুমুরিয়া ইউনিয়নের গাজীরহাট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করেন জান্নাতুল আরফিন। এরপর আর্থিক সংকটের কারণে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিলেও আত্মীয়দের সহায়তায় ফেনীর জিয়া মহিলা কলেজে ভর্তি হন তিনি। সেখান থেকেও জিপিএ-৫ পেয়ে এইচএসসি পাস করেন তিনি।

জানা যায়, স্বামীর মৃত্যুর পর চার সন্তান নিয়ে অথৈই সাগরে পড়েন শাহিদা আক্তার। বাড়িতে সেলাই মেশিনের কাজ করে, টিউশনি করিয়ে, আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতায় সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়ে যান তিনি। স্বামীর ভাগে পাওয়া মাত্র ৫ শতাংশ ধানের জমি ২০২৩ সালে তিন লাখ টাকায় বিক্রি করেন শাহিদা আক্তার। সেই অর্থেই বড় মেয়ের কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষাব্যয় মেটানো হয়েছে এতদিন। এইচএসসি শেষে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিতে প্রথম দফায় কোচিং বাবদ প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়। প্রথমবার কাঙ্ক্ষিত ফল না পেয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন আরফিন। পরবর্তীতে দ্বিতীয়বার চট্টগ্রামে কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে আরও প্রায় ৫০ হাজার টাকা ব্যয় করেন।

কঠোর পরিশ্রম, অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও আত্মবিশ্বাসের ফল হিসেবে ২০২৫–২৬ শিক্ষাবর্ষের মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষায় আরফিন ৪০৪১তম স্থান অর্জন করে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পান। তবে ভর্তি, বইপত্র ও অন্যান্য খরচ নিয়ে এখন দুশ্চিন্তায় পড়েছেন আরফিন ও তার পরিবার।

শাহিদা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেয়ের বাবাকে হারানোর পর খুব কষ্টের মধ্যে দিন কেটেছে। অভাবের সংসারে পড়াশোনা চালানো কঠিন ছিল। তবুও আরফিন কখনো হাল ছাড়েনি। আজ তার এই সাফল্য আল্লাহর রহমত। আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছি। আমার মেয়ে যেন মানুষের মতো মানুষ হতে পারে এই দোয়া করি।

তিনি আরও বলেন, পরিবারের শেষ সম্বল ধানের জমি বিক্রি করে মেয়েকে কোচিংয়ে ভর্তি করিয়েছি। এখন ভর্তি, বইসহ অনেক খরচ। সামনে কিভাবে পড়াশোনা চলবে তা নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি। এটি এখন নতুন করে কপালে ভাজ পড়েছে। মেয়ে মানুষ এতদূরে থাকবে পড়ালেখা করবে সেটি এখনও স্বপ্ন। আল্লাহর কাছে চাই তিনি যেন একটা ব্যবস্থা করে দেন।

নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে জান্নাতুল আরফিন প্রথমেই মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, স্বপ্নের মেডিকেলে চান্স পাওয়ায় আল্লাহর দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া। অষ্টম শ্রেণিতে বাবাকে হারানোর পর জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় শুরু হয়। অনেক সময় মনে হয়েছে পড়াশোনা চালানো সম্ভব হবে না। কিন্তু আমার মা আমাকে কখনো হাল ছাড়তে দেননি। তিনি একাই আমার বাবা এবং মায়ের ভূমিকায় ছিলেন।

তিনি আরও বলেন, প্রথমবার মেডিকেলে চান্স না পেয়ে ভেঙে পড়েছিলাম। মনে হয়েছিল আমাকে দিয়ে আর হবে না। কিন্তু আমার পড়াশোনার জন্য মা জমি বিক্রি করেছেন। এই বিষয়টি আমাকে আরও বেশি দায়িত্বশীল করেছে। দ্বিতীয়বার চট্টগ্রামে কোচিং করতে তিন মাসে আমার প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। মেডিকেল কলেজে ভর্তি ও পড়াশোনা অনেক ব্যয়বহুল। সেটি কিভাবে ম্যানেজ হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে তিনি বলেন, এই সাফল্য শুধু আমার একার নয়। এটি আমার মা, শিক্ষক ও শুভানুধ্যায়ীদের সম্মিলিত অর্জন। ভবিষ্যতে একজন ভালো চিকিৎসক হয়ে দরিদ্র ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই। যারা আমার জন্য দোয়া ও সহযোগিতা করেছেন সবার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করতে চাই। আমি যেন সবার উপকারে আসি সেই দোয়া চাই। একজন মানবিক ডাক্তার হতে চাই।

গাজীরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মানিক চন্দ্র মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, জান্নাতুল আরফিন অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থী ছিল। বাবার মৃত্যুর পর সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেও চেষ্টা থামায়নি। আর্থিক সংকটে নতুন বই বা প্রাইভেট পড়ার সুযোগ না থাকলেও নিজের প্রচেষ্টায় এসএসসিতে জিপিএ–৫ অর্জন করেছে। তার এই সাফল্য অন্য শিক্ষার্থীদের জন্য অনুপ্রেরণা।

বিদ্যালয়ের সভাপতি ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী রবিউল হোসেন সুজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, জান্নাতুল আরফিনের এই সফলতায় আমি অশ্রুসিক্ত। মেয়েটি আমার ফুফাতো বোনের মেয়ে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালে তার বাবা মারা যায়। চরম দারিদ্র্য ও প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে আজ সে এই পর্যায়ে এসেছে। তার জন্য একটি দিনও সহজ ছিল না। অদম্য আরফিনকে অভিনন্দন ও স্যালুট। মানুষের মতো মানুষ হয়ে মানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার প্রত্যাশা রইল।

হাসিব আল আমিন/আরকে