আমের কাঙ্ক্ষিত দাম না পেয়ে বাগান উজাড় করছেন রাজশাহীর চাষিরা
গত পাঁচ থেকে ছয় বছর ধরে আমের কাঙ্ক্ষিত দাম পাচ্ছেন না চাষিরা। বছর বছর মৌসুমী এই ফলটির উৎপাদন খরচ বাড়লেও দামে হতাশ চাষিরা। ফলে আম চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে উজার করা হচ্ছে ছোট-বড় আমের বাগান। রাজশাহী জেলায় গত দুই বছরে বিভিন্ন জাতের এক হাজার হেক্টরের বেশি আমের গাছ কাটা হয়েছে। ফলে আগামী মৌসুমগুলোতে আমের উৎপাদন কমার সঙ্গে টান পড়বে অর্থনীতিতে।
আম চাষিরা বলছেন- করোনাকালে বিক্রি ও আমের দামের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন চাষিরা। তারপর পাঁচ বছরেও চাঙ্গা হয়নি আমের বাজার। করোনার সময় ছাড়াও রমজান মাস, ঈদ, পূজার ছুটির প্রভাব পড়ে আমের বাজারে। মূলত আমের মূল ক্রেতারা এসব ছুটির কারণে বড় বড় বিভাগীয় শহর ছেড়ে বাসায় ফিরেছিলেন। ফলে চাহিদা কমায় ভাটা পড়ে আমের দামে। লোকসান থেকে পরিত্রাণে বাধ্য হয়ে আমবাগান কেটে ধান, গম, সবজি, আদা, হলুদ, পেয়ারা, বরই, ড্রাগন চাষে ঝুঁকছেন চাষিরা।
বিজ্ঞাপন
তবে জেলায় আমবাগান উজার রোধে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ছাড়াও বন বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যকরী প্রদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। এর ফলে প্রতিদিনই কাটা পড়ছে আমের বাগান।
যে কারণে কাটা হচ্ছে আমের বাগান
বিজ্ঞাপন
গেল দুই বছরে জেলার বাঘা ও চারঘাট উপজেলায় সরকারি হিসেবে আমের বাগান কেটে ফেলা হয়েছে ৭১৪ হেক্টর জমির। তবে সংশ্লিষ্টদের দাবি- পুরো জেলায় উজাড় হয়েছে এক হাজার হেক্টরের বেশি আমের বাগান। কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জেলার ১৯ হাজারের মধ্যে শুধুমাত্র বাঘায় কাটা হয়েছে ৫১০ হেক্টরের বাগান। সবচেয়ে বেশি আমের গাছ কাটা হয়েছে জেলার চারঘাট-বাঘা উপজেলায়।
দুই বিঘা জমিতে এক যুগ আগে, ক্ষিরসাপাত, ল্যাংড়া, আম্রপালির মতো জাতের ৩০টি আম গাছ রোপণ করেছিলেন রাজশাহী পুঠিয়ার ধাঁধাশ গ্রামের হবি মিয়া। তিনি সেই বাগান এবার কেটে ফেলেছেন। তিনি বলেন, আমের দাম নেই, তাই কেটে ফেলা হচ্ছে আমের বাগান। তার আমের বাগান কাটছেন কাঠ ব্যবসায়ী জাহিরুল ইসলাম।
হবি মিয়া বলেন, দুই বিঘা জমিতে ৩০টা আমের গাছ। ফজলি, লেংড়া, ক্ষিরসাপাত, লক্ষ্মণভোগ আমের গাছ ছিল। আমের দাম কমে যাওয়ার করণে গাছগুলো বিক্রি করা হয়েছে। এখন ফসল ফলানো হবে জমিতে।
কাঠ কাটা শ্রমিক আবদুল মোমিনের আমের বাগান রয়েছে। তিনি বলেন, আমের দাম না পাওয়ার কারণে মানুষ প্রচুর গাছ কেটে ফেলছে। আম চাষে মুনাফা পাচ্ছে না। মৌসুমে বাজারে আমের যে দাম তাতে খরচ ওঠে না। আর যে সব জেলায় আমের গাছ ছিল না, সেই সব এলাকায় এখন আমের বাগান হয়েছে। এর ফলে চাহিদায় ভাটা পড়ছে। এতে করে আমের দামেও প্রভাব পড়েছে।
বানেশ্বর হাটের আম ব্যবসায়ী আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, আমের দাম পাচ্ছেন না চাষিরা। এক বিঘা জমির আমে চাষে বছর শেষে যে টাকা পাওয়া যাবে, ফসল চাষে তার থেকে বেশি টাকা পাওয়া যাবে। বিগত কিছু বছর ধরে আমের দাম পাচ্ছেন না চাষিরা। তাই বিকল্প আয়ের উৎস হিসেবে আমের গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। এরপর এসব জমিতে মালিকরা ফসল ফলাবেন।
যে কারণে দাম পাচ্ছেন না চাষিরা
গত দুই বছরে পুঠিয়া, পবা, চারঘাট, বাঘাসহ জেলায় অন্তত এক হাজার হেক্টর জমির আমবাগান উজাড় করা হয়েছে। নির্বিচারে কাটলেও ন্যূনতম বাধার সম্মুখীন হননি কেউ। কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় ১৯ হাজার হেক্টর আমের বাগান রয়েছে। বাগান মালিকদের দাবি- এবার সবচেয়ে বেশি রেকর্ড সংখ্যক গাছ কাটা হচ্ছে, যা কৃষি বিভাগের তথ্যের দ্বিগুণ।
চাষি ও ব্যবসায়ীরা জানান, রাজশাহীতে যখন আমের ভরা মৌসুম, তখন দেশের বিভিন্ন বাজারে আমের সরবারহ প্রচুর। সেই সময় শুধু রাজশাহীর নাম দিয়ে পাল্লা দিতে হয় আমকে। কিন্তু সেই জায়গাগুলোতেও অন্য অঞ্চলের আম চলে রাজশাহীর নামে। তবে আমগুলো বিক্রি হয় নেহাত কম দামে। তখন ক্রেতারা অল্প দামে অন্য অঞ্চলের আম কিনে খান রাজশাহীর বলে।
চারঘাটের হেলালপুরে আবদুল মজিদের আমের বাগানে গাছ রয়েছে ২৬টি। তিনি সব গাছ কেটে ফেলবেন বলে জানিয়েছেন।
বাঘার মনিগ্রামের বাগান মালিক গোলাম মোস্তফা বলেন, পুরো বাগানের আমের গাছ কাটা হবে। এই বাগানে ৩৪টি গাছ রয়েছে। ৮৪ হাজার টাকা দামে বড় সব গাছগুলো কেনা হয়েছে। তিন দিনে ৯টি গাছ কাটা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব গাছ কাটা হবে। আমের দাম না পাওয়ার কারণে গাছগুলো বিক্রি করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী জুলফিকার আলী বলেন, চাষিরা আম গাছ কাটছেন, এর মূল কারণ লাভ কমে গেছে। আমের উৎপাদন কমে গেছে। মার্কেটে দাম তেমন পাচ্ছে না। আগে রাজশাহী অঞ্চলে প্রচুর আম হতো। এখন নওগাঁ সেই জায়গাটা দখল করেছে। সাতক্ষীরা এখন বান্দরবানের কিছু এলাকায় আমের চাষ হচ্ছে। রাজশাহীতে এক সময় ধানের চাষ বেশি হতো। চাষিরা মনে করেছিলেন ধানের থেকে আম চাষ লাভজনক। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে চালের দাম বেশি ও ডিমান্ডও বেশি। তার কারণে এখন দেখা যাচ্ছে- চাষিরা মনে করছেন আম বাদ দিয়ে আমাদের ধানচাষে চলে যাওয়া ভালো। এটা একটা বড় কারণ।
তিনি বলেন, আমাদের রাজশাহীর আমগুলো লেট ভেরাইটির। সাতক্ষীরার আমগুলো বাজারে আগে আসে। তারা কিছু ভালো দাম পায়। রাজশাহী, নওগাঁ ও রংপুর অঞ্চলের আমগুলো বেশিরভাগই লেট ভেরাইটিস। এইসব আমগুলো একই সময়ে বাজারজাতকরণ হয়। এই কারণে প্রচুর আম বাজারে সরবরাহ চলে আসে। সঙ্গত কারণে দাম কমে যায়। আম যেহেতু একটি প্রচনশীল দ্রব্য, ইচ্ছা করলেই চাষিরা আলু বা অন্য ফসলের মতো রেখে দিতে পারেন না। সংরক্ষণের উপায় নেই। যার কারণে দাম না পেয়ে তার পরের বছর আর চাষিরা এটা চাষ করতে চান না।
বাগান কেটে ফেলা জমিতে কী চাষ হবে?
রাজশাহী জেলার জমিতে প্রায় সব ধরনের ফসল ফলানো সম্ভব। জেলায় প্রতিবছর ধান, গম, সবজি, পাট, আখের চাষ হয়। আর ছাঁয়া যুক্ত জমিতে আদা-হলুদ চাষ করা হয়। শুধু তাই নয়- পানির অভাব এমন এলাকায় পেয়ারা, বরই, মাল্টা, ড্রাগনের চাষ হয়। এসব কারণে আমের বাগান কেটে অধিক লাভজনক ফসলের দিকে ঝুঁকছেন চাষিরা।
হাবিব নামের এক বাগাগ মালিক বলেন, এক বিঘা জমির ওপরে আমের বাগান। সেই বাগান কেটে ফেলা হচ্ছে। বছরে বাগান থেকে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা পাওয়া যেত। কিন্তু সেখানে কোনো ফসল হতো না। গাছ কাটার পড়ে এই বাগান জমিতে রূপান্তিরিত হলো। এখন সব ফসল ফলানো যাবে।
অধ্যাপক কাজী জুলফিকার আলী বলেন, মানুষের উপার্জন কিন্তু কমে গেছে। উপার্জন কমে যাওয়ার কারণে, তারা আগে প্রধান খাদ্য শষ্য কিনবেন, তারপর আম, লিচু, কলা এগুলো কিনবেন। চালের দাম বাড়ার কারণে মানুষ উপার্জনের সঙ্গে সামঞ্জস্য করতে পারছে না। যার কারণে আমের আগের মতো ডিমান্ড কিন্তু নেই। ডিমান্ড যদি না থাকে তাহলে দাম কমে যাবে। দাম কমে যাওয়ার কারণে চাষিদের লাভ কমে যাবে। লাভ কমে যাওয়ার কারণে পরের বছরে সে আর উৎপাদন করবে না।
রাজশাহীর চেয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-নওগাঁর চাষিরা আমের দাম ভালো পান
দাম না পাওয়ার কারণে হিসেবে রাজশাহীর চাষি ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাজশাহীর আগে বাজারে আসে সাতক্ষীরার আম। নতুন আম হিসেবে তারাও ভালো দাম পান। রাজশাহীতে যখন আমের ভরা মৌসুম, তখন সারাদেশের বাজারে কম-বেশি বিভিন্ন জাতের আম পাওয়া যায়। ফলে নাম দিয়ে দামের হিসেবে সুবিধা করতে পারে না রাজশাহীর আম। তবে বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর চাষিরা লেট ভ্যারাইটি আম চাষে ভালো দাম পান। আমের দিক থেকে রাজশাহীর বাজার সমৃদ্ধ হলেও অর্থনীতিতে চাঙ্গা এই দুই জেলার বাজার।
কী হয় এসব আমের কাঠ দিয়ে?
আমের কাঙ্ক্ষিত দাম না পাওয়ার কারণে চাষিরাই নিজেদের আমের বাগান উজার করছেন। কেউ শ্রমিক নিজেই, আবার কেউ পুরো আমের বাগানের গাছ বিক্রি করে দিয়েছেন। কাঠ ব্যবসায়ীরা কেটে নিচ্ছেন এসব বিভিন্ন বয়সের আমের গাছগুলো। রাজশাহীর চারঘাট ও বাঘার পথের ধারে আম গাছের কাটা অংশ কিছুদিন থেকে হরহামেশায় চোখে পড়ছে।
ছোট ও অল্প বসয়ী আমের গাছগুলো সাধারণত জ্বালানির কাজে ব্যবহার হয়। বাসা বাড়ি ছাড়াও সেই আমের কাঠ বিক্রি হয় ইটের ভাটায়। এছাড়াও মোটামুটি কাঠগুলো দিয়ে আবাসন নির্মাণের মিস্ত্রিরা সাটারিংয়ের কাজে ব্যবহার করেন। এছাড়া বিভিন্ন বোর্ড কোম্পানিগুলো কিনে নেয় আমের এসব কাঠগুলো। এছাড়া ৩০-৪০ বছর বসয়ী আমের কাঠগুলো দিয়ে আসবাবপত্র তৈরি করা হয়।
এ বিষয়ে রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (উদ্যান) পাপিয়া রহমান মৌরী বলেন, রাজশাহী জেলায় দুই বছরে সাড়ে ৪০০ হেক্টর জমির আম গাছ কাটা হয়েছে।
রাজশাহী সামাজিক বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম জানান, ব্যক্তি পর্যায়ে গাছ কাটার তথ্য তাদের কাছে নেই। তারা বনের বিষয় দেখেন।
রাজশাহী পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোছা. তাছমিনা খাতুন বলেন, কতগুলো গাছ কাটা হয়েছে এমন হিসাব আমাদের কাছে নেই। তবে যদি কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ করে। আমরা বিষয়টি দেখব। গাছ কাটার কারণে পরিবেশের ক্ষতি হবে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর দীর্ঘ মেয়াদি প্রভাব পড়বে।
আরএআর