উত্তরাঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জেলা বগুড়ায় বিগত এক বছরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত জেলায় ৫৭টি হত্যাকাণ্ড এবং ৪১১টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। তুচ্ছ ঘটনা থেকে শুরু করে সামাজিক আধিপত্য বিস্তার, মাদক ও পারিবারিক কলহ, নানা কারণে এসব প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। হঠাৎ করে অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় জনমনে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে।

সর্বশেষ, ৩০ ডিসেম্বর রাতে বগুড়া সদর উপজেলার নুনগোলা ফাপড় এলাকায় রিফাত জাহান রিংকি (১৯) নামে এক গৃহবধূর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। নিহতের পরিবার এটিকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করেছে, তবে স্থানীয়ভাবে কেউ কেউ এটিকে আত্মহত্যা বলে প্রচার করছে। সরাসরি কেউ বক্তব্য দিতে রাজি হননি। পুলিশ জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত আত্মহত্যার কোনো সুস্পষ্ট আলামত পাওয়া যায়নি।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, এতে জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা বেড়েই চলেছে। বিচারহীনতার কারণে হত্যাকাণ্ডের মতো ভয়ংকর অপরাধ হঠাৎ করেই বেড়েছে। আইনের কঠোর প্রয়োগ না থাকায় অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তুচ্ছ ঘটনায় মানুষের জীবন চলে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতির জন্য সামাজিক অবক্ষয়কে দায়ী করছেন তারা।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধসহ নানা কারণে সম্প্রতি হত্যার ঘটনা বেড়েছে। তবে প্রশাসন হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও রহস্য উদঘাটনেও কাজ করছে।

বছরজুড়ে বগুড়ায় কিছু আলোচিত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, ১ মার্চ ২০২৫, মা ও মেয়েকে ছুরিকাঘাতে হত্যা, বগুড়া সদর সাবগ্রামে ঘরে ঢুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আনোয়ারা বেগম (৫৮) ও তার মেয়ে সকিনাকে (৩৫) হত্যা করা হয়। পারিবারিক মনোমালিন্যকে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ড বলে পুলিশ জানিয়েছে।

১৫ জুন ২০২৫, অটোরিকশা চালককে মারধর ও হত্যা, বগুড়ায় স্কুলছাত্রী মেয়েকে বিয়ে করতে না দেয়ার বিরোধকে কেন্দ্র করে শাকিল আহমেদকে (৪০) দলবদ্ধভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

১৬ জুলাই ২০২৫, দুই নারীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা, ইসলামপুর হরিগাড়ী রাতে বাড়িতে ঢুকে দুজন নারীকে ছুরি দিয়ে হত্যা করা হয়, একজন আহত হয়। পরে ডিবি পুলিশ প্রধান অভিযুক্তকে আটক করে।

১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ প্রবাসীর স্ত্রী ও ছেলেকে হত্যা,বগুড়ার শিবগঞ্জে কুয়েত প্রবাসীর স্ত্রী রানী বেগম ও ছেলে ইমরান হোসেনকে ঘরে ঢুকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। পরে পুলিশের অভিযানে নিহতের ভাই ও সহযোগী আটক হয়।

২৮ অক্টোবর ২০২৫, যুবককে কুপিয়ে হত্যা, শহরের সেউজগাড়ী হাবিবুর রহমান খোকনকে (৩৫) দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করে, আরেকজন আহত হয়।

৬ নভেম্বর ২০২৫ সৎ বাবাকে পিটিয়ে হত্যা, বগুড়ার কাহালু উপজেলায় নেশার টাকার জন্য এক ব্যক্তি তার সৎ বাবাকে খুন করে। পরবর্তীতে গ্রেপ্তার করা হয়।

২৫ নভেম্বর ২০২৫, সেনাসদস্যের বাসা থেকে পরিবারের লাশ উদ্ধার, বগুড়ার শাজাহানপুরে ছুটিতে বাড়ি আসা এক সেনাসদস্যের বাসা থেকে তার দুই সন্তানের গলাকাটা ও স্ত্রীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। এঘটনায় তার স্বামীকে আটক করে পুলিশ। 

জেলা পুলিশের তথ্য মতে, ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বগুড়া জেলার ১২টি উপজেলায় মোট ৫৭টি খুন এবং ৪১১টি আত্মহত্যা সংঘটিত হয়েছে। এছাড়া ডাকাতি ও দস্যুতার ৪৯টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে বগুড়া সদর এলাকায় অপরাধের হার সবচেয়ে বেশি। মোট ১৪টি খুনের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে আশঙ্কাজনক বিষয় হলো, এখানে ১০০টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।

শাজাহানপুর থানায় আইনশৃঙ্খলার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এখানে ৭টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। পাশাপাশি এই এলাকায় ৩২টি আত্মহত্যার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে।

শিবগঞ্জ থানায় খুনের ঘটনা ঘটেছে ৪টি। অন্যদিকে, এই এলাকায় আত্মহত্যার প্রবণতা বেশ বেশি, যার সংখ্যা ৩৭টি। সোনাতলা থানার তথ্যানুযায়ী, এখানে ২টি খুনের ঘটনা ঘটেছে এবং ২০টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।

গাবতলী এলাকায় অপরাধের চিত্রে দেখা যায়, এখানে ৪টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া এই থানায় ২৬টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।
সারিয়াকন্দি থানায় খুনের ঘটনা ঘটেছে ৩টি। একই সময়ে এই এলাকায় ২৭ জন আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে।

আদমদিঘী থানায় খুনের ঘটনা তুলনামূলক কম হলেও আত্মহত্যার হার অনেক বেশি। এখানে ২টি খুনের বিপরীতে ৩৫টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। দুপচাচিয়া থানার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এখানে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৪টি এবং আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ৩৭টি।

নন্দীগ্রাম থানায় গত সময়ে খুনের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে ৪টি। তবে এখানে জেলার অন্যান্য থানার তুলনায় আত্মহত্যার সংখ্যা কিছুটা কম, যা ১৬টি।

কাহালু থানার তথ্যমতে, এই এলাকায় ৩টি খুনের ঘটনা ঘটেছে এবং ২১টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। শেরপুর থানায় অপরাধের চিত্র কিছুটা উদ্বেগজনক। এখানে ৭টি খুনের ঘটনার পাশাপাশি ৩২টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ধুনট থানায় খুনের ঘটনা ঘটেছে ৩টি এবং আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ২৮টি।

জেলায় মোট ৫৭টি খুন এবং ৪১১টি আত্মহত্যার পাশাপাশি ১৪টি ডাকাতি ও ৩৫টি দস্যুতার ঘটনা ঘটেছে।

বগুড়া জেলার সিনিয়র আইনজীবী আব্দুল হান্নান বগুড়ার বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলেন, রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের চলাচলের স্বাধীনতা এবং জানমালের নিরাপত্তা পাওয়া সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু বর্তমানে বগুড়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে চরম অবনতি ঘটেছে, তাতে সাধারণ মানুষের সেই আইনি সুরক্ষা বিঘ্নিত হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে পুলিশের কর্মতৎপরতা হ্রাস পাওয়ায় অপরাধীরা বিচারহীনতার সুযোগ পাচ্ছে। ফলে মানুষ সন্ধ্যার পর রাস্তায় বের হতে এবং দিনের বেলাতেও একা চলতে নিরাপত্তা বোধ করছে না।

​তিনি আরও বলেন, অপরাধ প্রবণতা দমনে এবং জনমনে স্বস্তি ফেরাতে প্রচলিত আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃশ্যমান সক্রিয়তা এখন সময়ের দাবি। দ্রুত কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে এই বিশৃঙ্খলা থামানো সম্ভব হবে না।

সরকারি আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ ও অপরাধ বিশ্লেষক মোস্তফা কামাল বলেন, বিচারহীনতার কারণে এসব ঘটনা বেড়েই চলেছে। পারিবারিক সম্পর্কের দুর্বলতা, নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতার কারণে মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে, যা অপরাধীদের সুযোগ দিচ্ছে। দ্রুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সক্রিয় করা জরুরি।

বগুড়ার অ‌তি‌রি‌ক্ত পুুলিসুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) হুসাইন মোহাম্মদ রায়হান ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজনৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধসহ নানা কারণে সম্প্রতি হত্যার ঘটনা বেড়েছে। পুলিশ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার করেছে এবং রহস্য উদঘাটনে কাজ করছে। শুধুমাত্র পুলিশ প্রশাসন কঠোর হলে এসব অপরাধ দমন সম্ভব নয়। সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে। আশা করি শিগগিরই এ ধরণের অপরাধ কমে আসবে।

আব্দুল মোমিন/আরকে