বৃহত্তর ময়মনসিংহ এবং কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও কুড়িগ্রামসহ এই অঞ্চলের প্রায় দুই কোটি মানুষের চিকিৎসাসেবার অন্যতম ভরসাস্থল এক হাজার শয্যা বিশিষ্ট ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতাল। হাসপাতালটিতে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে গত বছরের জুনে চালু করা হয় করোনা ইউনিট। 

হাসপাতালের পূর্ব পাশে নতুন ভবনের পঞ্চম থেকে অষ্টম তলায় স্থাপিত এই ইউনিটের সাধারণ ওয়ার্ডে ১০০ শয্যা আর আইসিইউতে ১০টি শয্যা নিয়ে শুরু হয়েছিল কার্যক্রম। তবে এ বছর রোগী বাড়তে থাকায় ক্রমান্বয়ে বাড়ানো হচ্ছে শয্যা সংখ্যা। বর্তমানে সাধারণ ইউনিটে ৩০০ শয্যা এবং আইসিইউতে ২০টি শয্যা রয়েছে।

সোমবার (০৫ জুলাই) দুপুর পর্যন্ত রেকর্ড সংখ্যক ২৯৬ জন রোগী ভর্তি আছেন মমেক হাসপাতালের করোনা ইউনিটে। খালি নেই আইসিইউর ২০ শয্যার একটিও। 

বিপুল সংখ্যক রোগীকে সেবা দিতে হিমশিম খেলেও চেষ্টার কোনো কমতি রাখছেন না চিকিৎসকরা। প্রতিদিন সার্বক্ষণিক সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন হাসপাতালের ৪০ থেকে ৫০ জন চিকিৎসক।

দুপুর সোয়া ১২টার দিকে করোনা ইউনিট থেকে বের হন টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার সুইটি হাজং (৩৫)। সঙ্গে ছিল তার পরিবার। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, করোনায় আক্রান্ত হয়ে আটদিন এখানে চিকিৎসাধীন ছিলাম। এখানকার ডাক্তার-নার্সদের সঠিক সেবাই আমরা পেয়েছি। কাঙিক্ষত যে সেবা পাওয়ার কথা ছিল সেটাই আমরা পেয়েছি।

কথা হয় হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ডা. আবরার আল সাকিবের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, গত কয়েকদিন ধরে রোগী বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আমরা সার্বক্ষণিক করোনা রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছি। করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সাধারণ মানুষ যেন সরকারি নির্দেশনাগুলো মেনে চলেন।

বন্ধ হচ্ছে না মৃত্যুর মিছিল

মমেকের করোনা ইউনিটে কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না মৃত্যুর মিছিল। সবশেষ ১০ দিনে  করোনা ইউনিটে মারা গেছেন ৯০ জন। যার মধ্যে করোনা শনাক্ত হয়ে ৩৬ জন এবং উপসর্গ নিয়ে ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় প্রাণ গেছে ১৫ জনের।

দুপুর সাড়ে ১২টায় করোনা ইউনিটের পঞ্চম তলা ও পাশের আইসিইউর সামনে গিয়ে দেখা গেল রোগীর স্বজনদের অপেক্ষা আর আহাজারির চিত্র। কেন বন্ধ হচ্ছে না মৃত্যু, এমন প্রশ্ন ছিল করোনা ইউনিটের মুখপাত্র ডা. মহিউদ্দিন খান মুনের কাছে।

তিনি বলেন, আগে আমাদের হাসপাতালে যে রোগীগুলো ভর্তি হতো তাদের বেশিরভাগই ছিল মৃদু এবং মাঝারি উপসর্গের। কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা যেটা দেখছি প্রতিদিন প্রচুর সংখ্যক রোগী ভর্তি হচ্ছেন। ভর্তি হওয়া রোগীর বেশিরভাগই গুরুতর অসুস্থ। এজন্য মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না।

ডা. মহিউদ্দিন খান আরও বলেন, রোগীর চাপ বৃদ্ধির কারণে আমাদের ওপরও চাপ বেড়েছে। কিন্তু আমাদের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের যথেষ্ট আন্তরিকতা আছে। আমরা চেষ্টা করছি এই চাপটাকে সামাল দিয়ে সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার।

বাড়ানো হচ্ছে করোনা ওয়ার্ড ও জনবল

এতদিন পঞ্চম তলা থেকে অষ্টম তলা পর্যন্ত করোনা ইউনিট থাকলেও রোগী বাড়ার কারণে বাড়ানো হচ্ছে এর পরিসর। এ ব্যাপারে করোনা ইউনিটের মুখপাত্র ডা. মহিউদ্দিন খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভবনের তৃতীয় ও চতুর্থ তলা করোনা ইউনিটে সংযুক্ত করা হয়েছে। এখানে যে নন-কোভিড ওয়ার্ডটি ছিল সেটি পুরাতন ভবনে স্থানান্তর করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, হাসপাতালের যে জনবল রয়েছে সেটিকে কোভিড ইউনিটের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে। সেই সঙ্গে অতিরিক্ত রোগী সামলানোর জন্য ময়মনসিংহ বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতর এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। চাপ সামলাতে যে লজিস্টিক সাপোর্ট দরকার, যেমন অক্সিজেন ও অন্যান্য ওষুধ, সেটার মজুত বৃদ্ধি করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত পর্যাপ্ত অক্সিজেন রয়েছে। ৪০টি হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা রয়েছে। এর মাধ্যমে আইসিইউ সমমানের সেবাটা আমরা দিতে পারছি। এই মুহূর্তে যেভাবে চলছি তাতে আশা করছি রোগীদের ভালোভাবেই সেবা দিতে পারব।

অক্সিজেন সংকট হবে না

হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. ফজলুল কবীর বলেন, বিভিন্ন জায়গায় অক্সিজেনের স্বল্পতা বা হাহাকারের কথা আমরা শুনছি। তবে ময়মনসিংহ মেডিকেলে অক্সিজেনের কোনো সংকট নেই। ইনশাল্লাহ অদূর ভবিষ্যতেও সংকট হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। রোগী যদি দ্বিগুণ হয়ে যায় তবুও সংকট হবে না। কারণ আমরা আগে থেকেই কিছু ব্যবস্থা করে রেখেছি। ফলে আমরা একটা আস্থার অবস্থানে রয়েছি। কোম্পানিগুলো নিয়মিত অক্সিজেন সাপ্লাই দিয়ে যাচ্ছে।

হাসপাতালে কোনো সেবাই বন্ধ নেই জানিয়ে তিনি আরও বলেন, লকডাউনের কারণে আমাদের এখানে নন-কোভিড নিয়মিত রোগী অনেকাংশে কমে গেছে। যেখানে প্রতিদিন আড়াই থেকে তিন হাজার রোগী ভর্তি থাকত সেখানে ১৫শ থেকে ১৮শ রোগী আছে। একইভাবে বহির্বিভাগেও রোগীর সংখ্যা কমে গেছে। সেজন্য করোনার চাপ সামলেও সকল সেবা চলমান রয়েছে। নন-কোভিড রোগীর ব্যাপারে অবহেলার সুযোগ নেই।

আরএআর/জেএস