যশোর করোনা ডেডিকেটেড ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডগুলোতে শয্যা সংকট দেখা দিয়েছে। রোগীদের ঠাঁই হয়েছে মেঝেতে। অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্সরা। রেড ও ইয়োলো জোন মিলিয়ে মোট ১৪২টি শয্যার বিপরীতে সোমবার দুপুর পর্যন্ত রোগী ভর্তি হয়েছেন ২১২ জন। দায়িত্বে রয়েছেন মাত্র দুজন চিকিৎসক। ফলে রোগী সামলাতে দৌড়ের ওপর থাকতে হচ্ছে তাদের।

এমন পরিস্থিতিতে জেনারেল হাসপাতালে আরও ৫০টি শয্যা এবং বেসরকারি ছয়টি ক্লিনিকে নতুন করে ১০০ শয্যা বাড়ানোর প্রস্তুতি নিয়েছে জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। একই সঙ্গে অতিরিক্ত ২০ চিকিৎসক চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরে আবেদন করেছেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আখতারুজ্জামান।  

সোমবার (৫ জুলাই) হাসপাতালের করোনা আইসোলেশন ওয়ার্ড (ইয়োলো) জোন ঘুরে দেখা গেছে, ওয়ার্ডে পুরুষ ও নারীদের জন্য ৫০টি শয্যা রয়েছে। সোমবার নতুন ভর্তি হওয়া ১৫ জন নিয়ে সেখানে ৮৬ রোগী ভর্তি রয়েছেন। হাসপাতালের মেঝেতে সারি সারি বিছানা ফেলে রোগী রাখা হয়েছে। রোগীর চাপে ওয়ার্ডে দাঁড়ানোর পর্যাপ্ত জায়গাও নেই। 

জানা গেছে, করোনা উপসর্গ নিয়ে কেউ ভর্তি হলে তাকে প্রথমে এ ওয়ার্ডে রাখা হয়। পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পাঠানো হয়। করোনা পজিটিভ হলে করোনা ইউনিটে (রেড জোন), আর নেগেটিভ হলে সাধারণ ওয়ার্ডে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। বর্তমানে মেঝেতেও রোগীদের জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না।

এ ওয়ার্ডে আলম নামে এক রোগীর স্বজন জানান, করোনা উপসর্গ নিয়ে বাবাকে ভর্তি করা হয়েছে। তার শ্বাসকষ্টও আছে। গত ২ জুলাই রাতে ভর্তি করালেও বেড পাওয়া যায়নি। রোগীর যে চাপ চিকিৎসকরা হিমশিম খাচ্ছেন।

তিনি অভিযোগ করেন, হাসপাতালের নার্সরা ভালো ব্যবহার করছেন না। এখানকার পরিবেশও ভালো নয়। টয়লেট নোঙরা, মেঝেও অপরিষ্কার।

পাশের ইয়োলো জোনের মহিলা ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, নয়টি শয্যার একটিও ফাঁকা নেই। ওয়ার্ডের মেঝে ও বারান্দায় রোগীরা শুয়ে আছেন।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় যশোর জেনারেল হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। ইয়োলো জোনে করোনার উপসর্গ নিয়ে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

রেড ও ইয়োলো জোনে ২৪ ঘণ্টায় তিন শিফটে (৮ ঘণ্টা করে) দায়িত্ব পালন করেন চিকিৎসকরা। প্রতি শিফটে একজন করে চিকিৎসক দায়িত্বে থাকেন। নার্স (সেবিকা) থাকেন সাতজন। ১৪ দিন পরপর শিফট পরিবর্তন হয়। রোগী হিসাবে চিকিৎসক-নার্সের সংখ্যা অপ্রতুল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার আরিফ আহম্মেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সোমবার পর্যন্ত ২১২ জন ভর্তি রয়েছেন। যা আগে ৫০-৬০ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এ অবস্থা চলতে থাকলে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে যাবে। বাড়ি থেকে খুবই খারাপ অবস্থায় রোগীরা হাসপাতালে আসছেন। হাসপাতালে আনার পর চিকিৎসা শুরু না হতেই তারা মারা যাচ্ছেন। আর একটু আগে এলে এত মৃত্যু হতো না।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে রেড জোনে ১৪২টি শয্যা রয়েছে। আরও ৫০ শয্যার একটি রেড এবং ২৪ শয্যার আরেকটি ইয়োলো ওয়ার্ড নতুন করে সংযুক্তির প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। কোনোভাবে রোগীর চাপ সামলানো যাচ্ছে না। পরিস্থিতি সামাল দিতে আরও ২০ চিকিৎসক চেয়ে স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালকের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’

যশোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কাজী সায়েমুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, যশোর জেনারেল হাসপাতালে করোনা রোগীদের চাপ বেড়ে যাওয়ায় শহরের জনতা হাসপাতালে ৩০টি, ইবনে সিনা হাসপাতালে ২০টি, নোভা মেডিকেল সেন্টারে ১৫টি, জেনেসিস হাসপাতালে ১৫টি, আধুনিক ও কুইন্স হসপিটালে ২০টি শয্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এখন থেকে বেসরকারি এসব হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য ১০০টি শয্যা সংরক্ষিত থাকবে। যশোর জেনারেল হাসপাতাল থেকে এখানে পাঠানো রোগীদের চিকিৎসা চলবে। অপেক্ষকৃত কম অসুস্থ করোনা রোগীদের বেসরকারি এসব হাসপাতালে পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে। জনস্বার্থে হাসপাতালগুলো নিজস্ব অর্থায়নে করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেবে।

ভাড়া করা যন্ত্র ও টেকনিশিয়ান দিয়ে চলে ইসিজি 

যশোর জেনারেল হাসপাতালের করোনা ডেডিকেটেড জোনে রোগীদের পরীক্ষার জন্য কোনো ইসিজি যন্ত্র নেই। অথচ কর্তব্যরত চিকিৎসকদের পরামর্শে করোনা পজিটিভ ও সন্দেহভাজনদের ইসিজি করতে হয়। এক্ষেত্রে বাইরে থেকে টেকনিশিয়ান ও যন্ত্র এনে ইসিজি (ইলেকট্রো-কার্ডিয়োগ্রাম) সম্পন্ন করতে হয়। 

এদিকে, বাইরে থেকে যাদের দিয়ে ইসিজি করানো হয়, তাদের অনেকেই টেকনিশিয়ান নন বলে জানা গেছে। দীর্ঘদিন টেস্ট করার মধ্য দিয়ে তারা বিষয়টি আয়ত্ত করেছেন মাত্র। ফলে তাদের করা পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিট ও প্যাথলজি বিভাগ ছাড়া আর কোথাও ইসিজি মেশিন নেই।

ভাড়া করা যন্ত্র ও টেকনিশিয়ান দিয়ে চলে ইসিজি 

করোনায় আক্রান্ত ও উপসর্গ নিয়ে যশোর জেনারেল হাসপাতালের রেড ও ইয়োলো জোনে ভর্তি হওয়া রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চিকিৎসকরা রোগীর ইসিজি করাতে বললেও ওয়ার্ডে কোনো ইসিজি যন্ত্র নেই। তাই বাধ্য হয়ে তাদের বাইরের ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে যেতে হয়। সেখান থেকে যন্ত্র ও লোক এনে ইসিজি রিপোর্ট করাতে হয়। ফলে দুর্ভোগে পড়তে হয় তাদের। 

ওয়ার্ডে ইসিজি যন্ত্র না থাকায় রোগীর স্বজনদের বাইরে ছুটতে হচ্ছে। ফলে তাদের মাধ্যমে হাসপাতালের বাইরেও করোনা ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের যেসব কর্মী ইসিজি করছেন তারাও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। আক্রান্ত হওয়াসহ তাদের মাধ্যমেও সংক্রমণ ছড়াতে পারে।

ইসিজি যন্ত্র না থাকার বিষয়ে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আখতারুজ্জামান বলেন, বিষয়টি জানা ছিল না। বাইরে থেকে যন্ত্র ও টেকনিশিয়ান এনে ইসিজি করানোর বিষয়টি অবগত নই। বিষয়টি দ্রুত সমাধান করা হবে।

৩ দিনে করোনায় আক্রান্ত ৩৩ নার্স

এদিকে, গত তিন দিনে (১ জুলাই থেকে ৩ জুলাই) যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের ৩৩ নার্স করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।  

করোনা ওয়ার্ডের ইনচার্জ হোসনেয়ারা খাতুন বলেন, ‘করোনা ওয়ার্ডে কাজ করে প্রতিদিন ভয়ে ভয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরি। কখন জানি আমার মাধ্যমে পরিবারের অন্যরা আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তবে যতটা সম্ভব সাবধানতা অবলম্বন করে সেবা দিয়ে যাচ্ছি। অসুস্থ মানুষের সেবা দেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। সেবা নিতে আসা মানুষগুলোর দায়িত্ব কোনোভাবেই একজন নার্স এড়িয়ে যেতে পারেন না।’

হাসপাতালের উপ-সেবা তত্ত্বাবধায়ক ফেরদৌসী বেগম বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। প্রতিদিন জ্বর, ঠান্ডা ও শ্বাসকষ্ট রোগী বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালের বেডে জায়গা হচ্ছে না। মেঝেতে ও বারান্দায় রেখে সেবা নিচ্ছেন রোগীরা। হাসপাতালের ইনডোরে করোনা আইসোলেশন ইউনিটের প্রতিটি বেডেই রোগী। সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।’

তিনি বলেন, যশোর জেনারেল হাসপাতালে ২৩২ নার্স রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৩৩ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন গত তিন দিনে। এছাড়া জ্বর বা ঠান্ডা নিয়ে প্রতিদিন কেউ না কেউ ছুটিতে থাকছেন। মাতৃত্বকালীন ছুটিও রয়েছে। এভাবে নার্সরা আক্রান্ত হলে কয়েক দিন পর সেবা দেওয়ার মতো সুস্থ নার্স থাকবে না। নার্সের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

জাহিদ হাসান/ওএফ