শের-ই-বাংলা স্মৃতি জাদুঘর

বরিশাল বিভাগের প্রথম জাদুঘর নিয়ে সবার আগ্রহ থাকলেও অব্যবস্থাপনার কারণে দর্শনার্থী সংকট দেখা দিয়েছে। জাদুঘরের নিয়ম মেনে চলতে দর্শনার্থীদের উৎসাহিত না করা, কর্মরতদের দায়িত্ব অবহেলায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। 

যদিও কর্মকর্তারা বলছেন, করোনার কারণে দর্শনার্থী কমে গেছে। অব্যবস্থাপনার কোনো সুযোগ নেই। কেউ দায়িত্বে অবহেলা করছেন না।

দর্শনার্থীরা বলছেন, উপমহাদেশের রাজনীতিতে প্রভাবশালী নেতার বাড়িতে জাদুঘর নির্মাণ করে দায়িত্ব শেষ করা দায়িত্বহীনতা। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তার জীবনাদর্শ পৌঁছে দিতে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি হাতে নেওয়া উচিত ছিল। এর ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা নেতৃত্ব দিতে শিখবেন, তৈরি হবে যোগ্য নেতা।

শের-ই-বাংলা স্মৃতি জাদুঘরে ঢোকার জন্য টিকিট কাটছেন দর্শনার্থীরা

বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার চাখার ইউনিয়নের চাখার গ্রামে জন্ম নেওয়া আবুল কাসেম ফজলুল হক বা এ কে ফজলুল হক নেতৃত্ব গুণে উপমহাদেশের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন। খেটে খাওয়া মানুষের পক্ষে কাজ করে রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে সমাদৃত এ কে ফজলুল হক ১৯৩৭ সালে ঋণ শালিসবোর্ড গঠন করে ভারতের লহ্মৌর সম্মেলনে উপাধি পান শের-ই-বাংলা অর্থাৎ বাংলার বাঘ। ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যাওয়া এই নেতার স্মরণে ১৯৮২ সালে বানারীপাড়ায় প্রতিষ্ঠা করা হয় শের-ই-বাংলা স্মৃতি জাদুঘর।

শের-ই-বাংলার বাড়িতে ২৭ শতাংশ জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত জাদুঘরটি বরিশাল বিভাগের প্রথম জাদুঘর। এখানে শের-ই-বাংলার ব্যবহৃত কিছু তৈজসপত্র, আলোকচিত্র এবং তাকে দেওয়া উপহারসামগ্রী রয়েছে। অধিকাংশ সময় কলকাতায় থাকায় শের-ই-বাংলার ব্যবহার্য অনেক তৈজসপত্র উদ্ধার করা না যাওয়ায় জাদুঘরে সংরক্ষণ সম্ভব হয়নি।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনা অঞ্চলের আওতায় পরিচালিত জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে সবশ্রেণির মানুষের কৌতূহলের কেন্দ্রে ছিল। কিন্তু এটি সঠিকভাবে দেখভাল হচ্ছে না বলে অভিযোগ দর্শনার্থীদের।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী সোহেল রানা বলেন, জাদুঘরের প্রধান শর্ত হল এখানে প্রদর্শিত সামগ্রী মানুষ দেখতে আসবে। পাশাপাশি ঐতিহাসিক গুরুত্ব বুঝবে। কিন্তু শের-ই-বাংলা জাদুঘরের এমন কোনো কর্নার নেই; যার ছবি ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে না। দর্শনার্থীরা এখানে এসে গুরুত্বপূর্ণ সব জিনিসের ছবি তুলে নিয়ে যান। এতে জাদুঘর গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে।

শের-ই-বাংলা স্মৃতি জাদুঘরের সামনে চাখার খাল

সোহেল রানা বলেন, আমি দেখেছি দর্শনার্থীরা জাদুঘরের মধ্যে ছবি তুলছেন। দায়িত্বরতরা চেয়ারে বসে মোবাইলে ব্যস্ত। একই অভিযোগ করেছেন ‘সাইকেলে দেশ ঘুরে দেখা’ টিমের সদস্য রাফসান। 

অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার দেবাশীষ কুন্ডু বলেন, শের-ই-বাংলা স্মৃতি জাদুঘর বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের ইতিহাসের একটি মূল্যবান সম্পদ। এখানে উপস্থিত হয়ে যা অনুধাবন করা যায়, যে ইতিহাসের সাক্ষী হওয়া যায় তা কখনও ইন্টারনেটে প্রাপ্ত ছবি দেখে বোঝা যায় না। কাজেই জাদুঘরে আসা মানুষগুলো অবশ্যই সচেতন মানুষ। কিন্তু সচেতন হয়েও যদি তারা ভেতরে সুরক্ষিত ঐতিহাসিক নির্দশনের ছবি তুলে ছড়িয়ে দেন সেটি অন্যায়। এটি সচেতনতার নামে মূর্খতা। এমন যারা করেন তারা জাদুঘরকে ক্রমে ক্রমে মূল্যহীন করছেন।

শুক্রবার (০৮ জানুয়ারি) সরেজমিনে জাদুঘর ও শের-ই-বাংলার পৈতৃক সম্পত্তি এলাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা যায়, দর্শনার্থীর উপস্থিতি বেশ। সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে জাদুঘরে এসেছেন।

শুক্রবার সপরিবারে ঐতিহাসিক এই জাদুঘর দেখতে আসা কলেজশিক্ষক মাহাবুবুর রহমান বলেন, আমরা যদি সন্তানদের শের-ই-বাংলা, শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা ভাসানীর মতো নেতাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে না দিই তাহলে ছেলেমেয়েরা অজ্ঞ থাকবে। প্রত্যেকের উচিত সময় পেলেই ঐতিহাসিক স্থানগুলো পরিদর্শনে যাওয়া। 

শের-ই-বাংলার বসতভিটার একাংশে নির্মিত এই জাদুঘর

কলেজশিক্ষক মাহাবুবুর রহমান আরও বলেন, জাদুঘরটি আরও সমৃদ্ধ ও পরিপাটি হতে পারত। এখানের দায়িত্বরতদের মধ্যে ইতিহাস, শ্রদ্ধা, সংরক্ষণ বা দায়িত্ব পালনে ঘাটতি রয়েছে। তারা চেষ্টা করলে দর্শনার্থীদের বিশৃঙ্খল আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। কিন্তু করছেন না। তারা শুধু চাকরি করছেন। এভাবে চললে মানুষ জাদুঘরে আসবে কেন, ঘরে বসে ইন্টারনেটে সব দেখে নেবে। জাদুঘরের গুরুত্ব ধরে রাখতে সবাইকে সচেতন হতে হবে।

টিকিটের বিনিময়ে শুক্রবার শের-ই-বাংলা স্মৃতি জাদুঘরে প্রাপ্তবয়স্ক দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল ৭৯ জন এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক দর্শনার্থী ছিল ২০ জনের বেশি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জাদুঘরের ইনচার্জ বলরাম দাস।

তিনি বলেন, ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ৬ জানুয়ারি অর্থাৎ এক সপ্তাহে প্রাপ্তবয়স্ক দর্শনার্থী ছিল ২০২ জন। অপ্রাপ্তবয়স্ক দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল ৪০ জন। করোনা আঘাত হানার পর গত বছরের ১৮ মার্চ জাদুঘর বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করার শর্তে ওই বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর উন্মুক্ত করা হয়। দিন যতেই যাচ্ছে ততই দর্শনার্থী বাড়ছে। করোনা সংক্রমণের আগে দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেই থাকত।

সরেজমিনে দেখা যায়, জাদুঘরের কক্ষগুলোর সংরক্ষিত জিনিসগুলোর ছবি তুলছেন দর্শনার্থীরা। একে-অপরের সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা করছেন। আবার অনেকে মোবাইলে উচ্চশব্দে কথা বলে অন্যদের বিরক্ত করছেন।

বাবুগঞ্জ উপজেলার মাধবপাশা ইউনিয়নের বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম জাদুঘরের দ্বিতীয় কক্ষে শের-ই-বাংলার ব্যবহৃত খাটের সঙ্গে সেলফি তুলছিলেন। জাদুঘরের ভেতরে ছবি তোলা নিষিদ্ধ হলেও ছবি কেন তুলছেন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ইতিহাসের মানুষের খাটের সঙ্গে নিজের ছবি তুলে ঐতিহাসিক হয়ে যাব, তাই তুলেছি। শুধু সাইফুল ইসলাম নন, অনেক দর্শনার্থী গোপনে ও প্রকাশ্যে ছবি ও সেলফি তুলছেন। 

এরই মধ্যে সাংবাদিকের উপস্থিতি টের পেয়ে তৎপর হন জাদুঘরে দায়িত্বরত স্টাফ। তিনি ছবি তোলার বিষয়টি ইনচার্জকে জানানোর কথা বলে সটকে পড়েন। 

জাদুঘর অযত্ন অবহেলায় পড়ে থাকার পেছনে আরও অনেক কারণ আছে বলে জানালেন সরকারি ফজলুল হক কলেজের স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থী পরভেজ হোসেন মল্লিক।

তিনি বলেন, ২০০৩ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উদ্যোগে শের-ই-বাংলা স্মৃতি জাদুঘরের মুখপত্র প্রকাশনা বের করা হয়। প্রকাশনাটি জাদুঘর কর্তৃপক্ষ ৯৭ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়। উদ্বেগের বিষয়, সেই মুখপত্র পুস্তিকায় জাদুঘরের ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনের সব ছবি ছেপে দেওয়া হয়েছে। এমন বই যদি বিক্রি করা হয়; তাহলে তো জাদুঘরে আসার দরকার নেই। মানুষ ওই বই থেকে সব কিছু দেখে নেবে।

শের-ই-বাংলা রেস্টহাউস

এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, আমি দেশের বাইরে ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছি। সেখানে দেখেছি মোবাইল-ক্যামেরা নিয়ে জাদুঘরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। এমনকি আমাদের জাতীয় জাদুঘরেও অত্যন্ত কঠোর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা হয়। কিন্তু শের-ই-বাংলা স্মৃতি জাদুঘরে কিছুই রক্ষা করা হয় না।

এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে শের-ই-বাংলা স্মৃতি জাদুঘরের ইনচার্জ বলরাম দাস সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে প্রেরিত একটি অফিস আদেশ দেখিয়ে বলেন, ওপরের নির্দেশ আছে; গণমাধ্যমে কোনো তথ্য দিতে হলে মহাপরিচালকের অনুমতি লাগবে। অন্যথায় তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করতে হবে।

আলাপের একপর্যায়ে বলরাম দাস বলেন, পেশাগত জীবনের ৩২ বছর শের-ই-বাংলা জাদুঘরে দায়িত্ব পালন করছি। জাদুঘরের ভেতরে ছবি তোলার অনুমতি নেই দর্শনার্থীদের। কিন্তু যারা আসেন তারা আমাদের কথা শোনেন না। চুরি করে হলেও ছবি তুলে নিয়ে যান।

বরিশালের চাখারে চাখার বালক উচ্চ বিদ্যালয় ও ওয়াজেদ স্মৃতি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ২৭ শতক জমির ওপর শের-ই-বাংলা স্মৃতি জাদুঘরের অবস্থান।

শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হকের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য জাদুঘরটি নির্মাণ করা হয়। ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাদুঘর নির্মাণের কাজ শুরু করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। 

শের-ই-বাংলার বসতভিটার একাংশে নির্মিত জাদুঘরটির দৈর্ঘ্য ৮৩ মিটার এবং প্রস্থ ১৪.৬০ মিটার। ১৯৮৩ সালে জাদুঘরের কার্যক্রম শুরু হয়। বিরল আলোকচিত্র, ব্যবহৃত আসবাবপত্র, চিঠিপত্র ও শের-ই-বাংলাকে উপহার হিসেবে পাঠানো সৈয়দ আনিছুজ্জামান নামক ব্যক্তির সুন্দরবন থেকে শিকার করা কুমির দিয়ে জাদুঘরটি সাজানো হয়।

জাদুঘরটি চারকক্ষ বিশিষ্ট। যার দুটি প্রদর্শনী কক্ষ, একটি অফিস কক্ষ ও একটি গ্রন্থাগার। জাদুঘরে ঢুকলে বাম দিকে শের-ই-বাংলার একটি বিশাল প্রতিকৃতি, তার জীবনকর্মের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, সামাজিক রাজনৈতিক, পারিবারিক ছবি, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত শের-ই-বাংলার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ছবি দেখা যায়। 

জাদুঘরে শের-ই-বাংলার ব্যবহৃত জিনিসের মধ্যে আছে আরাম কেদারা, কাঠের খাট, তোশক, আলনা, ড্রেসিং টেবিল, টুল, চেয়ার-টেবিল, হাতের লাঠি, গ্লাস এবং কিছু মালপত্র। 

জাদুঘরে কালো পাথরে নির্মিত অষ্টভুজা মারীচী দেবী মূর্তি, কালো পাথরের বড় শিবলিঙ্গ, ব্রোঞ্জের খসপর্ণ বৌদ্ধ মূর্তি, স্বর্ণমুদ্রা, সাধা পাথরের ছোট শিব মূর্তিসহ ছাপাঙ্কিত রৌপ্য মুদ্রা, শ্রীলঙ্কা, ব্রিটিশ ও সুলতানি আমলের তাম্র মুদ্রাসহ অন্যান্য প্রত্ন নিদর্শন প্রদর্শিত হয়। জাদুঘরের গেটের পাশেই রয়েছে টিকিট কাউন্টার।

জাদুঘরে প্রাপ্তবয়স্কদের প্রবেশ ফি ১০ টাকা, মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঁচ টাকা, সার্কভুক্ত প্রবাসী নাগরিকদের ৫০ টাকা এবং সার্কভুক্ত নয় এমন রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রবেশ ফি ১০০ টাকা।

এএম