হাশেম ফুডসের সেজান জুস কারখানায় অগ্নিকাণ্ড

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাশেম ফুডসের সেজান জুস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড এবং এতে অর্ধশত শ্রমিকের জীবন্ত পুড়ে কয়লা হওয়ার মতো ঘটনায় নিজেদের দায় এড়ানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু করেছে একাধিক সরকারি সংস্থা। বিশেষ করে, যাদের দিকে আঙুল উঠছে নজরদারির না করার তারা একে অন্যকে দোষ দিচ্ছে।

ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা কিংবা শিশুশ্রম নিয়ে নানা অভিযোগ উঠলেও পরিবেশ অধিদফতর, কল-কারখানা অধিদফতর এবং ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, তারা নিয়মিত সেজান জুসের ওই কারখানা পরিদর্শন করত। এতগুলো মৃত্যুর পর এখন এসব সরকারি সংস্থার কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠছে নানা মহলে। সবার প্রশ্ন সংস্থাগুলো এতদিন কী করল?

ঢাকা পোস্টের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সেজান জুসের যে ছয়তলা ভবনটিতে আগুন লেগেছিল, সেটি তৈরির সময় বিল্ডিং কোড বা ইমারত বিধি মানা হয়নি। এমনকি সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে অনুমোদনও নেওয়া হয়নি। প্রতিষ্ঠানটির কোনো কর্মকর্তাই এ বিষয়ে সদুত্তর দিতে পারেননি বা কাগজপত্র দেখাতে পারেননি।

বৃহস্পতিবার বিকেলের দিকেই কারখানাটিতে আগুন লাগে

বিশাল ভবনে প্রতিটি তলার সিঁড়ি ছিল লোহার জালে ঘেরা এবং তালাবদ্ধ। এ কারণে কর্মঘণ্টা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই সিঁড়ি দিয়ে কখনোই নামতে পারতেন না শ্রমিকেরা। বিশাল এ ভবনে ছিল না কোনো ফায়ার এক্সিট বা ইমার্জেন্সি এক্সিট (জরুরি নির্গমণ পথ)। ইমার্জেন্সি এক্সিট বা বিকল্প সিঁড়ির ব্যবস্থা না থাকলে ফায়ার সার্ভিসের অনুমতি দেওয়ার কোনো বিধান নেই। তারপরও কারখানাটি ফায়ার সার্ভিস থেকে অনুমোদন পেয়েছে।

ভবনটিতে ছিল না কোনো ফায়ার অ্যালার্ম, হাইড্রেন্ট সিস্টেমের মতো পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম। বিশাল বিশাল ফ্লোরে (তলা) নামমাত্র দুই-থেকে তিনটি অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র থাকলেও সেগুলো ব্যবহারের নিয়ম কখনো শেখানো হয়নি শ্রমিকদের। অথচ হাশেম ফুডের মতো বিশাল কারখানায় যেখানে সাত হাজার শ্রমিক কাজ করতেন, সেখানে প্রতি বছর অগ্নিমহড়া হওয়ার কথা ছিল। তবে তা হয়নি। উল্টো শ্রমিকদের কাজ করার জায়গায় রাখা হতো ঝুঁকিপূর্ণ দাহ্য পদার্থ।

সরেজমিনে দেখা গেছে, কারখানার নিচতলা থেকে ছয়তলা পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে রাখা হতো রেজিন (প্লাস্টিক তৈরির কাঁচামাল, দানা), বাটার অয়েল, প্লাস্টিকের বোতল, মোড়ক, হিট ফোম, পলিথিন, মবিল, ডিজেল, প্যাকেজিং, কাগজের রোলসহ খাদ্যপণ্য তৈরির বিপুল পরিমাণ দাহ্য পদার্থ।

শ্রমিকদের কাজ করার জায়গায় রাখা হতো দাহ্য পদার্থ

এসব বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতর, নারায়ণগঞ্জের উপপরিচালক মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল-মামুনকে প্রশ্ন করলে তিনি গণমাধ্যমকে জানান, ‘আমাদের কর্মকর্তারা প্রতি মাসে সেখানে পরিদর্শন করতেন। যেহেতু ফুড আইটেম তৈরি করা হতো, সেহেতু বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যালের ব্যবহার ছিল।’

তিনি বলেন, ‘হাশেম কারখানার ঘটনাটি ফায়ার (আগুন) থেকে সৃষ্ট। তাদের পর্যাপ্ত ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থা ছিল না। আমরা ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স পাওয়ার পরই তাদের সনদ দিয়েছি। কারখানা পরিদর্শনের সময় আমাদের কর্মকর্তারা মূলত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিয়ে থাকেন।’

তবে ফায়ার সার্ভিসের দাবি, তারা দুর্বল অগ্নি-নিরাপত্তা নিয়ে কারখানাটিকে অনেকবার সতর্ক করে নোটিশ দিয়েছে। রাসায়নিক দ্রব্য দেখভালের দায়িত্ব তাদের নয় ।

 ঢামেক হাসপাতালের মর্গে মরদেহ নিয়ে এসেছে ফায়ার সার্ভিস

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক (রূপগঞ্জ) তানহারুল ইসলাম বলেন, কেমিক্যালের বিষয়টি দেখার দায়িত্ব অন্য সংস্থার। আমরা পর্যাপ্ত ফায়ার সেফটির বিষয়ে প্রতিটি কারখানাকে নোটিশ দিয়ে থাকি। এই কারখানা কর্তৃপক্ষকেও অনেকবার নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। আর শ্রমিকদের বিষয়টি কলকারখানা অধিদফতর তদারকি করে। তবে বারবার নোটিশের পরও কোনো আইনি পদক্ষেপ কেন নেওয়া হয়নি এমন প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি এই কর্মকর্তা।

অপরদিকে কলকারখানা অধিদফতর, নারায়ণগঞ্জের উপমহাপরিদর্শক সৌমেন বড়ুয়া বলেন, কারখানাটিতে আমাদের কর্মকর্তারা প্রায় প্রতি মাসেই পরিদর্শন করতেন। শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য ফায়ার সেফটি ও কেমিক্যালের বিষয়গুলো পরিবেশ অধিদফতর দেখে। আমরা অন্য বিষয়গুলো দেখি।

ভবন নির্মাণে মানা হয়নি বিল্ডিং কোড

এদিকে রূপগঞ্জের সেজান জুসের ওই কারখানায় কাজ শুরু করেছে জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের পৃথক তদন্ত কমিটি। উভয় তদন্ত কমিটির সদস্যরাই কথা বলা শুরু করেছেন সেই মর্মান্তিক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং মৃত্যুকূপ থেকে যারা ফিরে এসেছেন তাদের সঙ্গে।  

বিষয়টি নিশ্চিত করে জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটি সোমবার থেকে ঘটনাস্থলে সশরীরে কাজ শুরু করবে। ইতোমধ্যে রোববার থেকে নিহতের স্বজন, বেঁচে ফেরা শ্রমিক ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছে তদন্ত কমিটি। পাশাপাশি ঘটনার বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ ও পত্রিকার সংবাদ তদন্তের স্বার্থে সংগ্রহ করা হচ্ছে।

তদন্তের মাধ্যমে কার কী অবহেলা ছিল তা উঠে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন জেলা প্রশাসক।  

রাজু আহমেদ/আরএইচ/জেএস