জন্মের পর থেকে অ্যানেনসেফালি (মগজ কম) রোগে আক্রান্ত দুই ভাই। হাঁটাচলা তো দূরের কথা, দুই ভাই কথাও বলতে পারেন না, খেতেও পারেন না নিজ হাতে। শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্যহীনতা এবং দৈহিক গঠনের কারণে সবার কাছে অবহেলা-উপহাসের পাত্র দুই ভাই মো. রহিম (৪০) ও মো. অলি (৩৫)। তাদের মা মোসা. তাহমিনা বেগম (৬৫) মনে করেন- তার দুই ছেলে স্বর্গ থেকে এসেছে। 

রহিম-অলি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার রহনপুর পৌরসভার বিশ্বাসপাড়া মহল্লার মৃত ফানসুর আলী ও মোসা. তাহমিনা বেগম দম্পতির ছেলে। সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে রাতে ঘুমানো পর্যন্ত তাদের সবকিছুই করতে হয় মা তাহমিনা বেগমকে। এমনকি মা একটু চোখের আড়ালে গেলেই বাইরে চলে যান রহিম-অলি। তাই তাহমিনা বেগম বাড়ি থেকে বের হলে একজনকে ঘরের মধ্যে আটকে এবং আরেকজনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে যান। 

একদিকে গত চার দশক ধরে অসুস্থ দুই ছেলে, অন্যদিকে দারিদ্র্য। আট সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি রহিম-অলির বড় ভাই শাহাদাত হোসেন তোতা। ছোট্ট একটি মুদি দোকান চালিয়ে প্রতিবন্ধী দুই ভাইকে আগলে রেখেছেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর মা তাহমিনা বেগম দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে বড় করেছেন অসুস্থ রহিম-অলিসহ তিন ছেলে ও এক মেয়েকে। গত ৪০ বছর ধরে দুই ছেলেকে চোখে চোখে রেখেছেন। তিনি জানেন, তার চোখেই দুনিয়া দেখে দুই ছেলে, তার পা দিয়েই হেঁটে চলে রহিম-অলি। 

তাহমিনা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সব সময় একটা চিন্তায় থাকি, আমার তো বয়স হয়েছে। আমি না থাকলে তাদের কী হবে? কারণ তারা কারও কাছে থাকে না, কারও হাতে খায় না। দুই ভাইয়ের একজন তো মাকে ছাড়া ঘুমাতেই পারে না। তাদের জন্য এই চিন্তায় রাতে ঘুমও আসে না।

তিনি আরও বলেন, জন্মের পর থেকে তাদের মাথার আকৃতি ছোট ছিল। এরপর স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে ডাক্তাররা জানান- আমার ছেলেদের মাথায় মগজ কম। এর নাকি চিকিৎসাও নেই। এরপর থেকে তাদেরকে নিয়ে এভাবেই চলে যাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে প্রসাব-পায়খানা করানো, হাত-মুখ ধুয়ে দেওয়া দিয়ে দিনের শুরু হয়। এরপর মুখে খাবার তুলে দেওয়া, জামা-কাপড় পরানো, গোসল করানো সবকিছুই আমি করে দিই। এক কথায় তারা কিছুই করতে পারে না।

রহিম-অলির মা বলেন, তাদেরকে রেখে বাড়ির বাইরে যেতে পারি না। বাইরে গেলে একজনকে ঘরে বন্দি করে, আরেকজনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখে যেতে হয়। তারপরও একটু সুযোগ পেলেই বাইরে পালিয়ে যায়। প্রতিবেশীদের বাড়িতে গেলে তারাও তাড়িয়ে দেয় বা আমাকে খবর দেয়। আমি তাদের বাড়িতে নিয়ে আসি। 

তাহমিনা বেগম জানান, সবাই তাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, অবহেলা করলেও তাদেরকে নিয়ে ভালোই আছেন তিনি। নিজের পছন্দ, ভালোলাগা-মন্দলাগা বলে কিছুই নেই তাহমিনা বেগমের। ছেলেদের ভালো রাখাই তার সুখের একমাত্র উপাদান। এতো কষ্ট আর অবহেলা নিয়েও সুখী তাহমিনা বেগম, কিন্তু তার চিন্তা বা কষ্ট একটাই। তা হলো তার মৃত্যুর পর দুই ছেলে রহিম-অলির কী হবে?

প্রতিবেশী মো. শুকুর উদ্দিন বলেন, জন্মের পর থেকে দেখছি তারা এমন। একেবারেই অক্ষম, কিছুই করতে পারেন না। খুব কষ্টে তাদের দিন যায়। বড় ভাই তাদেরকে নিয়ে দোকানদারি করে সংসার চালায়। শত কষ্ট করেও খেয়ে, না খেয়ে দিন যাপন করছে তারা। সরকার এই পরিবারটির পাশে দাঁড়ালে তাদের জন্য খুবই ভালো হয়। 

পেশায় পেইন্টার আরেক প্রতিবেশী নূর মোহাম্মদ বাবু জানান, নিঃস্ব একটি পরিবারে জন্ম নিয়েছে দুই প্রতিবন্ধী ভাই। ৮ সদস্যের পরিবারটি দরিদ্র। রহিম-অলির বড় ভাইয়ের গ্রামের মধ্যে থাকা ছোট্ট একটি দোকান চালিয়ে তাদের সংসার চলে। সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসলে তারা একটু ভালো থাকত। 

তাহমিনা বেগমের বড় ছেলে মুদি দোকানি শাহাদাত হোসেন তোতা বলেন, আমার আয় খুবই সামান্য হলেও মা-ভাইদের নিয়ে একসঙ্গে থাকতে পারাটাই আমার কাছে আনন্দের। প্রতিবন্ধী হিসেবে দুনিয়ায় এসেছে, কিন্তু তারাও তো একই সৃষ্টিকর্তার তৈরি। আর্থিক অনটনে থাকায় সাময়িক মন খারাপ হলেও ভাইদের কখনো বোঝা মনে করেন না বলে জানান শাহাদাত। 

রহনপুর পৌরসভার মেয়র মতিউর রহমান খান মতি ঢাকা পোস্টকে বলেন, পৌর মেয়র নয়, একজন মানুষ হিসেবে তাদের পাশে দাঁড়াতে চাই। সকলেরই উচিত নিজেদের জায়গা থেকে তাদেরকে সহায়তা করা। একদিকে দুই প্রতিবন্ধী সন্তান, অন্যদিকে দারিদ্র্য। পৌরসভা ও আমি ব্যক্তিগতভাবে এই পরিবারটির জন্য একটি স্থায়ী উপার্জনের ব্যবস্থা করতে চাই। যা খুব শিগগিরই করা হবে। স্থানীয় ব্যবসায়ী, বিত্তবান, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সকলের প্রতি পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানাই।

গোমস্তাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান ঢাকা পোস্টকে জানান, দুই ভাইকে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। এমনকি আমি নিজেই তাদের বাসায় উপস্থিত হয়ে আশ্রয়ণ প্রকল্প থেকে দুটি ঘর নির্মাণ করে দিতে চেয়েছি। ঘর নির্মাণ কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এছাড়া তাদের বড় ভাইয়ের দোকানের পরিধি বাড়াতে ৩০ হাজার টাকা সহায়তা করা হয়েছে। 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. গোলাম রাব্বানী ঢাকা পোস্টকে জানান, অ্যানেনসেফালি আক্রান্তরা মায়ের পেট থেকেই এমন রোগ নিয়ে আসে। চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলার কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে সঠিকভাবে খেয়াল রেখে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করলে তারা অনেকটাই ভালো থাকে। তাই সকলের উচিত তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা এবং তাদের চলাফেরায় সহযোগিতা করা। 

তিনি আরও বলেন, মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নেয়ামত, রহিম-অলির মাকে দেখলে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তাদের বিষয়ে জানার পর মনে মনে ভাবছি- বৃদ্ধা মায়ের মৃত্যুর পর তাদের কী হবে, কোথায় যাবে, কার কাছে থাকবে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব রোগীদের জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করছেন। সরকারি সুযোগ-সুবিধার আওতায় নিয়ে আসতে পারলে এবং গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে পারলে তাদের জীবনযাপন কিছুটা হলেও স্বাভাবিক থাকবে। 

আরএআর/জেএস