জয়িতা আয়েশা আক্তার আজাদী

আয়েশা আক্তার আজাদী। ২০০৭ সালে ১৭ বছর বয়সে বিয়ে হয় তার। শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে খুশি রাখতে যৌতুকের দাবি পূরণ করেন বাবা-মা। কিন্তু তাতে সুখ মেলেনি। বেড়েছে কষ্ট। বিয়ের পর নিত্যদিনের নির্যাতনে বিভীষিকাময় জীবন শুরু হয় তার। এরপরও আঁকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছিলেন স্বামীর সংসার। দাঁতে দাঁত চেপে পড়েছিলেন দুই বছরেরও বেশি সময়। 

দুই বছরে একবারও তাকে বাবার বাড়ি যেতে দেয়া হয়নি। অবশেষে একদিন পাঠানো হয় বাবার বাড়ি। কথা ছিল ৫/৬ দিন পর এসে নিয়ে যাবেন শ্বশুরবাড়ির লোকজন। সেই আসাতেই স্বামীর বাড়ির ঠিকানা শেষ। অবশেষে মাস খানেক পর হাতে আসে ডিভোর্স লেটার। তবে এতে ভেঙে পড়েননি চট্টগামের চন্দনাইশ উপজেলার বরকল ইউনিয়নের কানায়মাদারী গ্রামের আবুল কালাম আজাদের মেয়ে আজাদী। 

কারণ জীবনে ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু এখানেই। সিদ্ধান্ত নেন মানুষের জন্য কাজ করবেন। আর কোনো নারী যাতে এমন  নির্যাতনের শিকার না হন সে উদ্দেশ্যে শুরু করেন নানান সামাজিক কাজ। বিভিন্ন এনজিওর সঙ্গে মিলে শুরু করেন নারী নির্যাতনবিরোধী কর্মকাণ্ড। মুক্তির পথে নিজে যেমন হেঁটেছেন,  গ্রামের নারীদেরও মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ‘জয়িতা’ সম্মাননা পুরস্কার পেয়েছেন। চট্টগ্রাম বিভাগের সেরা পাঁচ জয়িতার একজন তিনি। গত ৯ ডিসেম্বর মা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় তাকে ‘জয়িতা’ স্বীকৃতি দিয়েছে। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে নতুন উদ্যোমে জীবন শুরু করা নারীদের ক্যাটাগরিতে জয়িতা মনোনীত হন আজাদী।

আয়েশা আক্তার আজাদী তার জীবনের উত্থান-পতন, স্বামীর সংসারে নির্যাতন, ঘুরে দাঁড়ানো, নির্যাতনের ক্ষত মুছে জয়িতা ও জনপ্রতিনিধি হয়ে মানুষের কল্যাণে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলেছেন ঢাকা পোস্টের সঙ্গে।

আয়েশা আক্তার আজাদী জানান, পুলিশে চাকরি করতেন তার বাবা আবুল কালাম। বাবার চাকরির সুবাদে তারা থাকতেন কুমিল্লার দাউদকান্দিতে। সেখানকার হাসানপুর ডিগ্রি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছিলেন আজাদী। কিন্তু বাবার ব্রেইন স্ট্রোকে লন্ডভন্ড হয়ে যায় সব। অসুস্থ হওয়ায় চাকরি হারান বাবা। ভেঙে যায় ডাক্তারি পড়ার স্বপ্ন। চেষ্টা করেন পুলিশে যোগ দেয়ার। কিন্তু শর্তানুসারে বয়স না হওয়ায় পুলিশে চাকরিও হয়নি। পরে সব ফেলে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন ১৭ বছর বয়সে। বাবার পেনশনের টাকায় দেয়া হয় যৌতুক। কিন্তু তাতেও সন্তুষ্ট নয় শ্বশুরবাড়ির লোকজন। শ্বশুরবাড়ি থেকে নিত্য নতুন চাহিদার চাপ আসতে থাকে। দিতে না পারলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতেন স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যরা।

তিনি বলেন, বিয়ের ছয় মাসের মাথায় স্বামী বিদেশে যাওয়ার কথা বলে তিন লাখ টাকা এনে দিতে বলেন। কিন্তু এতো টাকা যোগাড় করার সাধ্য আমার পরিবারের ছিল না। কিছু টাকা দেয়াও হয়েছিল। এতেও সন্তুষ্ট করতে পারিনি। শাশুড়ির সাফ কথা আমি যেন স্বামীর সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগ না করি। আর স্ত্রী হিসেবেও দাবি না করি।

আজাদী জানান, এরই মধ্যে সন্তানসম্ভবা হন তিনি। শ্বশুরবাড়ি থেকে বলা হয়, পুত্র সন্তান জন্ম দিতে না পারলে বাড়িতে ঠাঁই হবে না। নিজ থেকেই যেন সংসার ত্যাগ করে চলে যান সেজন্য ঘরের যাবতীয় কাজ করানো হতো তাকে দিয়ে। সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও হাতে ধান মাড়াই, ধানের বস্তা আনা-নেয়া করানো হতো। মন মতো কাজ না হলে খেতে দেয়া হতো না তাকে। হাতের কাছে যা পাওয়া যেতো তা দিয়েই চলতো শারীরিক নির্যাতন।

সন্তান প্রসবকালে ন্যূনতম চিকিৎসাটুকুও  দেয়া হয়নি। ডিসেম্বরের এক শীতের রাতে আজাদী কন্যা সন্তানের  জন্ম দেন। কন্যা জন্মের খবরে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন শাশুড়ি। কনকনে ঠান্ডায় গোসল করানো হয় তাকে। অজ্ঞান হয়ে পড়েন তিনি। তোকিছুর পরও দাঁতে দাঁত চেপে স্বামীর সংসার আঁকড়েছিলেন আড়াই বছর। পুরোটা সময়ে একবারও যেতে দেয়া হয়নি বাবার বাড়ি। বাবার বাড়ি গেলে আর ঢুকতে দেয়া হবে না বলে জানানো হয়। অবশেষে একদিন পাঠানো হয় বাবার বাড়ি। কথা ছিল ৫/৬ দিন পরে এসে নিয়ে যাবেন তারা। কিন্তু মাস শেষে হাতে এলো ডিভোর্স লেটার। 

এসব কিছুর মধ্যে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন ব্রেন স্ট্রোকে অসুস্থ বাবা। হাসপাতালে নেয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় শিকার হন বাবা-মেয়ে দুজনই। বাবা মারা গেলেন। সংসারের বড় মেয়ে। ডিভোর্স পেয়ে স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি এসে থাকেন। সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে কাঁধে। বাচ্চাদের পড়াতে শুরু করেন। মায়ের সহায়তায় বাড়িতেই চালু করেন হাঁস-মুরগির ছোট্টো খামার। পরে চাকরি নেন এনজিও সংস্থা কোডেকের বৈকালিক স্কুলে। এতেও হয় না। খোঁজ পান ব্রাকের সাক্ষরতা বাড়ানোর ‘উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা’ কর্মসূচির। সে সময় সকাল-বিকেল দুটি স্কুল চালিয়েছেন তিনি।

জয়িতা আয়েশা আক্তার আজাদী জানান, ক্ষত মুছে ভাইয়ের সহায়তায় আবারও পড়াশোনা শুরু করেন। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ভর্তি হন পশ্চিম পটিয়া এ.জে. চৌধুরী কলেজে। পাস করেন উচ্চ মাধ্যমিক। ঝরে পড়া শিশুদের বিদ্যালয়মুখী করতে ঢুকে পড়েন স্কুল ম্যানেজিং কমিটিতে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে শুরু করেন ঝরে পড়া শিশুদের বিদ্যালয়ে ফেরানোর কাজ। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে গ্রামের মানুষের সঙ্গে কাজ শুরু করেন। এতে এলাকার মানুষের পরিচিত মুখ হয়ে উঠেন আজাদী।

আর মানুষের উৎসাহ আর সহযাগিতায় ২০১৬ সালের চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার বরকল ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জয়ী হন ৪,৫ ও ৬ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী সদস্য হিসেবে। জনপ্রতিনিধি হয়ে এলাকার অসচ্ছল ও পিছিয়ে পড়া নারীদের স্বাবলম্বী করতে তাদের সেলাই শেখানোর উদ্দোগ নেন। বিউটিশিয়ান হওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দেন। এতে স্বচ্ছলতা ফেরে প্রায় অর্ধশতাধিক পরিবারে। তার মাধ্যমে ‘ধাত্রী প্রশিক্ষণ’ পেয়েছেন একজন নারী।

জনপ্রতিনিধি হয়ে ইতোমধ্যে বন্ধ করেছেন সাতটিরও বেশি বাল্যবিবাহ। যাতে বাদ যায়নি বাল্যবিবাহে বসছে এমন বালকও। এলাকার কিশোরদের মধ্যে প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে গড়ে তুলেছেন ‘কিশোর-কিশোরী ক্লাব’। কবিতা আবৃত্তি ও গান চর্চার মতো সহপাঠ্যক্রমিক কাজে কিশোরদের অংশগ্রহণ বাড়াতেও কাজ করছে সংগঠনটি। ইতোমধ্যে এ রকম তিনটি ক্লাবে নিয়মিত কার্যক্রম চলছে। 

নানা দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে শুরু করেন বিএসএস পড়াশোনা। কিন্তু এতো বিপর্যয়েও থমকে দাঁড়াননি কখনো। বর্তমানে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসএস ৩য় বর্ষে পড়ছেন আজাদী।

জয়িতা আয়েশা আক্তার আজাদী বলেন, আর কোনো নারী যেনো এভাবে নির্যাতনের শিকার না হন সেজন্য তাদের পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখি। মানুষের জন্য আলোকিত ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে কাজ করতে চাই। নিজের কন্যা সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করতে চাই। 

আরএআর