সুন্দরবন-সংলগ্ন নদী-খালের মাছ রক্ষায় কোস্টগার্ডের অভিযান

কিছুতেই বন্ধ করা যাচ্ছে না সুন্দরবনের আশপাশের নদী-খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার। ফলে সুন্দরবনের মৎস্যভান্ডার নদী-খাল ক্রমশ-ই মাছশূন্য হয়ে পড়ছে। বিষ প্রয়োগ করায় শুধু মাছ-ই নয়, মারা যাচ্ছে অন্যান্য জলজ প্রাণীও। এতে একদিকে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বনজ সম্পদসহ পরিবেশের ওপর।

অন্যদিকে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে বাগেরহাটের উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দাদের। এই অবস্থায় জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষায় দ্রুত কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান বন সংশ্লিষ্টরা।

সুন্দরবনজুড়ে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সম্প্রতি বন বিভাগ, কোস্টগার্ড ও পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযানে বিষ দিয়ে ধরা মাছ, নৌকা, ট্রলারসহ কয়েকজন জেলেকে আটক করা হয়। এরপরেও দৌরাত্ম্য কমছে না অসাধু জেলে-ব্যবসায়ীদের।

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বনের মধ্যে আঁকা-বাকা নদী, খাল ও তিন নদীর মোহনা রয়েছে সতেরো শ বর্গকিলোমিটার। দেশের সমগ্র সংরক্ষিত বনভূমির অর্ধেকেরও বেশি অর্থাৎ ৫১ শতাংশ বনই হচ্ছে সুন্দরবন। এ বনে রয়েছে সুন্দরি, গেওয়া, গরান, পশুরসহ ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা।

প্রায় ৬ হাজার ১১৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের বনে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ ৩৭৫ প্রজাতির প্রাণী। নদ-নদীতে রয়েছে বিলুপ্তপ্রায় তালিকায় থাকা ইরাবতীসহ ৬ প্রজাতির ডলফিন ও ২১০ প্রজাতির মাছ। এসব জলজ-বন্যপ্রাণী বিষক্রিয়ায় হুমকির মুখে রয়েছে।

সুন্দরবন-সংলগ্ন রায়েন্দা এলাকার তরিকুল ও জান্নাত নামের দুই জেলে জানান, বাপ-দাদার আমল থেকেই সুন্দরবনের নদী-খালে মাছ ধরে আমাদের জীবিকা চলে। এই মাছ-ই আমাদের সব। কিন্তু কয়েক বছর ধরে বনে বিষ দিয়ে মাছ শিকার বেড়েছে।

তারা আরও জানান, প্রথম দিকে অল্প কিছু খালে বিষ দিলেও দিন দিন তা ভয়ংকর ভাবে বাড়ছে। আমাদের মতো সাধারণ জেলেদের ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। আমরা না-পারি বিষ দিতে না-পারি ভালোভাবে মাছ ধরতে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকার একাধিক জেলে জানান, বন বিভাগের অজান্তে বিষ দিয়ে মাছ শিকার কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এর সাথে বনের কেউ না কেউ অবশ্যই জড়িত রয়েছে। এই কথা বললে আবার মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। বিষ প্রয়োগের কারণে সাধারণ জেলেরা তেমন মাছ পান না।

সম্প্রতি বিষ দিয়ে মাছ শিকারের দায়ে জেল থেকে ছাড়া পাওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মোংলা চিলা এলাকার এক জেলে বলেন, কয়েক বছর আগে থেকে ব্যবসায়ীদের পরামর্শে মাছ ধর‌তে বিষ প্রয়োগ করা শুরু করি। আমরা বেশির ভাগ সময় বিষ দিয়ে চিংড়ি মাছ ধরি।

তিনি আরও বলেন, অল্প সময়ে বেশি মাছ পাওয়া যায়। তবে বিষ দিলে অন্য অনেক মাছের ক্ষতি হয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ কাজ করলেও আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। পরিবর্তন হয় বড় বড় মহাজনদের।

বন-সংলগ্ন শরণখোলার আশরাফ সিদ্দিকি, ফিরোজা আক্তার, সাইফুলসহ কয়েকজন জানান, আমাদের এলাকায় তেমন কোনো ঘের নেই। সুন্দরবনের মাছেই আমাদের আমিষের চাহিদা মেটে। জেলেরা বন থেকে মাছ আহরণ করে বাজারে নিয়ে আসলে আমরা ক্রয় করি। কিন্তু বিষ প্রয়োগের মাছ কি না তা আমাদের জানা নেই। তবে লোকমুখে শুনি অনেকে বিষ দিয়ে মাছ মারে।

বিষ দেওয়া মাছ উদ্ধার

সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, কীটনাশক দিয়ে মাছ ধরায় শুধু সুন্দরবনের মৎস্য সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, এই বিষাক্ত পানি পান করে বাঘ, হরিণ, বানরসহ অন্য বন্য প্রাণীরাও হুমকির মধ্যে পড়ছে। অন্যদিকে উপকূলীয় এলাকায় মানুষের পানীয় জলের উৎসগুলোও বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে।

সুন্দরবন সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম আকন বলেন, প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের ছত্রচ্ছায়ায় একশ্রেণির জেলে নৌকা ও ট্রলার নিয়ে বনের ভেতরে ঢুকে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করছেন। এতে শুধু মাছ নয়, পানি বিষাক্ত হয়ে অন্যান্য জলজ প্রাণীও মারা যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, বিষ দিয়ে মাছ শিকার করায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই কীটনাশক মিশ্রিত পানি ভাটার টানে যখন গভীর সমুদ্রের দিকে যায়, তখন সেই এলাকার মাছও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

জলজ-বন্যপ্রাণী রক্ষায় পুলিশের অভিযান

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান অনুষদের প্রভাষক রাবেয়া সুলতানা বলেন, এসব কীটনাশক যেখানে প্রয়োগ করা হয়, সেখানে ছোট-বড় সব প্রজাতির মাছ মারা যায়। পাশাপাশি জলজ উদ্ভিদও মারা যাচ্ছে। ফলে খাদ্য সংকট তৈরি হচ্ছে। কিন্তু যদি প্রাকৃতিক উপায়ে মাছ ধরা হয় তাহলে খাদ্যচক্রের ওপরে খুব বেশি প্রভাব পড়ে না।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বাগেরহাটের উপপরিচালক কৃষিবিদ শফিকুল ইসলাম বলেন, ফাইটার, রিপকর্ড এবং পেসিকল নামের কীটনাশক কৃষিকাজের জন্য চাষিরা ব্যবহার করে। এ সব কীটনাশক দিয়েই অসাধু জেলেরা বিভিন্ন খালে প্রয়োগ করে মাছ শিকার করে। 

কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের জোনাল কমান্ডার রিয়ার অ্যাডমিরাল এম আশরাফুল হক বলেন, বন বিভাগ চাইলে তাৎক্ষণিক আমরা তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করে থাকি। অপরাধীরা বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরে। আমরা বিভিন্ন সময়ে তাদের আটক করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে হস্তান্তর করি।

পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, বিষ দিয়ে মাছ শিকারির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমাদের প্রতিটি ক্যাম্প ও স্টেশনের বনরক্ষীদের কঠোর নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। এক বছরে অর্ধশত অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।

এমএসআর