‘মোর নিদানের সময় মোরে ছাইড়া যায় নাই। হ্যারে কি মুই হালাইতে পারি? ভ্যানতো চালাইতে পারি না; তাই টানতে টানতে বেতাগিদ্যা বরিশালে আইছি।’

বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় কথাগুলো বলছিলেন তাসলিমা বেগম। তার বাড়ি বাকেরগঞ্জ উপজেলায়। থাকেন স্বামীর বাড়ি বরগুনার বেতাগী উপজেলার উত্তর চান্দখালী গ্রামে।

চান্দখালী থেকে বৃহস্পতিবার (১০ ডিসেম্বর) স্বামীকে নিয়ে বরিশালের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন তাসলিমা। শনিবার (১২ ডিসেম্বর) বিকেলে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছান তিনি। শয্যাশায়ী স্বামী আব্দুল জলিল হাওলাদারকে নিয়ে ভ্যান টানতে টানতে বরিশালে আসেন তিনি।

ভ্যান টানতে টানতে ক্লান্ত হয়ে গেলে রাস্তায় বসে বিশ্রাম নিয়েছেন তাসলিমা। এরই ফাঁকে কথা হয় তার সঙ্গে। নিজের কষ্টের কথা জানিয়ে তাসলিমা বলেন, চাইলে শয্যাশায়ী স্বামীকে ছেড়ে চলে যেতে পারতাম। ভালো এক স্থান থেকে দ্বিতীয় বিয়ের প্রস্তাবও এসেছিল। কিন্তু সরাসরি না করে দিয়েছি। আমি তাকে নিয়ে থাকতে চাই।

তাসলিমা বলেন, আমার দুটি সন্তান রয়েছে। সংসারের মায়া বড় মায়া। যে নারী সংসার ছাড়ে তাকে আড় চোখে দেখে সবাই। আমি সংসার ছাড়তে চাই না।

স্পষ্ট করে কথা বলতে পারেন না গুরুতর অসুস্থ আব্দুল জলিল। ইশারায় বুকের দিকে হাত টানেন। এ সময় স্ত্রী তাসলিমা স্বামীর শার্টের ভেতর থেকে একটা ছবি বের করেন। ছবিটি বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন জলিল। ছবিতে স্বামী-স্ত্রী ও দুই সন্তান রয়েছে। এটি তাদের পারিবারিক ছবি। এজন্য বুকে জড়িয়ে রেখেছেন জলিল।

ছবিটি হাতে নিয়ে নিজের সংসারের বর্ণনা দিয়ে তাসলিমা বলেন, স্বামী অসুস্থ। এছাড়া সবই ঠিক আছে। আমরা সুখী পরিবার ছিলাম। ছেলে-মেয়েকে আত্মীয়ের কাছে রেখে স্বামীকে নিয়ে এখানে এসেছি।

তাসলিমা জানান, পাঁচ বছর আগে থেকে তাদের দুর্ভোগ শুরু হয়। বরগুনার বেতাগী উপজেলার উত্তর চান্দখালী গ্রামের কাজিরাবাদের আব্দুল জলিল রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন।

একদিন উপজেলা সদরে চুক্তিতে কাজ করতে যান তিনি। সেখানে নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে গুরুতর আহত হন জলিল। ভেঙে যায় তার কোমর। 

প্রথমে নড়াচড়া করতে পারতেন না। বছর খানেক হলো হাত ধরে বসানো যায়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে তাকে আবার শোয়াতে হয়। একটু সুস্থ হলেও দুই বছর হলো তার কোমরে ধরা পড়েছে টিউমার। চিকিৎসক বলেছেন, টিউমার অপসারণ করতে না পারলে ক্যানসার হবে। সেজন্য দরকার ৩০ হাজার টাকা।

তাসলিমা বেগম বলেন, আমার যখন বিয়ে হয় তখন আমি ছোট। এত কিছু বুঝতাম না। স্বামী অনেক মায়া করতো আমাদের। কখনও একবেলা আমাদের ছাড়া ভাত খাইতো না।

আমি যেদিন অসুস্থ হতাম সেদিন রাতে ঘুমাইতো না। সেই মানুষটাকে আমি অবহেলা করতে পারি না, ছেড়ে যেতে পারি না।

তিনি বলেন, ভালোবাসা আর দায়িত্বশীলতার তাগিদ থেকে ভ্যান চালাতে না পারলেও বরিশাল থেকে ৭০ কিলোমিটার ভ্যান টেনে এসেছি শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। গত তিনদিন রাতে ছিলাম বিভিন্ন যাত্রী ছাউনিতে। পথে পথে কিছুটা বিশ্রাম নিয়েছি।

অস্পষ্ট কণ্ঠে অসুস্থ আব্দুল জলিল বলেন, কত মানুষকে সরকার সাহায্য দেয়। আমারে দেয় না। ছেলে-মেয়ের দুর্ভোগ আর স্ত্রীর কষ্ট দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত। মনে চায় এদের কষ্ট না দিয়ে ভ্যান থেকে পড়ে মরে যাই। 

এএম